গুয়াহাটির পথে….

মেঘালয়ে আসার আগে রীতিমতো গবেষণা করেছেন মাহমুদ হাফিজ। বলা ভালো তিনিই আমাকে তার সফরসঙ্গী করেছেন। দর্শনীয় স্থানগুলোর তালিকা তৈরি করে পাঁচদিন ঘোরার একটি সিডিউল বানিয়েছেন যাতে আজ আমাদের চেরাপুঞ্জি যাওয়ার কথা। কাল, আমরা যখন শিলং আসছিলাম সিলেটের কবি পুলক কান্তি ধর কবি মাহমুদ হাফিজকে ফোন করে জানালেন ৮ তারিখে গুয়াহাটিতে কবিতা পাঠের আসর বসবে। তিনি আসবেন, আমরাও যেন যাই। এবার মেঘালয় যাত্রায় আসামের নামগন্ধ ছিল না। মাহমুদ হাফিজ সে পরিকল্পনা নাকচ করে দিলেও গুয়াহাটিতে যাবার ধারণাটি আমার মনে ধরে। কত ঘণ্টা লাগবে উত্তরপূর্ব ভারতের এই দুই প্রতিবেশী রাজ্যের রাজধানী টু রাজধানী যেতে জিজ্ঞেস করতেই যখন জানলাম যখন শুনলাম ট্যাক্সিতে আড়াই থেকে তিনঘণ্টা, তখন প্রবল ইচ্ছে জাগে পাশের রাজ্যটির এতবার শোনা রাজধানীতে যাওয়ার। প্রধান কারণ ছিল ভূপেন হাজারিকার অতুলনীয় গানগুলো, যা একটি প্রজন্মকেই উদ্ধুদ্ধ করেছিল। আমার আগ্রহকে আমলে নিয়ে মাহমুদ হাফিজ রাজী হলেন যেতে।

সেই পরিকল্পনা মতো আমি ও মাহমুদ হাফিজ রওয়ানা হই গুয়াহাটির উদ্দেশে, জলি ভাবী ও তুসু থেকে যায় শিলংয়ে। তাদের নিয়ে ভিন্ন পরিকল্পনা ড. স্ট্রিমলেট ডেখারের। নেহুর যে গেট দিয়ে কাল রাতে ঢুকেছিলাম, সেই গেটের বাইরেই পাওয়া যাবে শেয়ারের ট্যাক্সি, ভাড়া পড়বে মাথাপিছু বিশ রুপি- স্ট্রিমলেট ডেখার তাই বলেছিলেন। ট্যাক্সি আছে, তবে শেয়ারে যাবে না, রিজার্ভ যেতে হবে। ভাড়া দুশ রুপি। কোথায় চল্লিশ, আর কোথায় দুইশত। কিছুতেই দেড়শতে রাজি করাতে পারলাম না, অগত্যা কী আর করা? দু’শই সই। এসে নামলাম পুলিশ বাজার। এখান থেকে শেয়ার ট্যাক্সিতে যাওয়া যাবে গুয়াহাটি জনপ্রতি চারশ রুপি ভাড়ায়। এ জায়গা থেকে কিছুটা দূরে এক স্ট্যান্ডে গেলে টাটাসুমোতেও যাওয়া যাবে, ভাড়া হবে অর্ধেক। দেখি ট্যাক্সি অনেকগুলো, যাত্রী তেমন নেই, তাই চলছে যাত্রী টানার হাঁকডাক। ড্রাইভার তো ডাকছেই, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দালালরাও ডাকছে; গাড়ি থেকে যাত্রী নামামাত্র তারা ছেঁকে ধরছে। ওখানে গেলে আপনার নিজেকে ভিআইপি মনে হবে। দেখি দুজন খাসি রমণী একটি গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে। ওরা দুজন, আমরাও দুজন। চারজন মিলে গেলেই তো হাওয়াগাড়ি মেঘালয়ে উড়তে পারে। বাগড়া বাধালো এক বেরসিক পুরুষ, যে আগেভাগেই চালকের পাশের সিটটি বুক করে রেখেছে। প্রথমে চেষ্টা করি আমরা দুজন বলে তাকে অন্য গাড়িতে সরাতে; তা কোন বোকা রমণীসঙ্গ ছাড়ে? এখন রমণীসঙ্গ পেতে হলে হয় আমাকে অথবা মাহমুদ হাফিজকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। তখন চেষ্টা চলে রমণীদ্বয়কে ভাগিয়ে আনার। সেটা ব্যর্থ হলে আমরা যাই নতুন গাড়ির সন্ধানে। একটুর জন্য আলাপচারিতার সুযোগটি মিস হওয়াকে দুর্ভাগ্য মেনে বিরসবদনে অপেক্ষা করি আরও দুই সহযাত্রীর। যে দুজন দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন, দুজনেই পুরুষ, তা আলাপচারিতা পুরুষ সহযাত্রীর সাথেও চলে, তবে এ হলো পুরুষদের টেনিস আর মেয়েদের টেনিসের পার্থক্য, একটি থেকে অপরটি সহস্র যোজন দূরে।

পুলিশ বাজারটি একটু ঘিঞ্জি। এটিই শিলংয়ের মূল জায়গা বলা যায় mall। সেখানে পৌঁছেই মাহমুদ হাফিজ আমাকে যে দালানটির দিকে চোখ ফেরাতে বলেন তা হলো হোটেল সেন্টার পয়েন্ট। তিনদিন নেহু ক্যাম্পাসে কাটিয়ে শেষ দিনটিতে এই হোটেলে এসেই আমরা উঠবো। অপর দুজন সহযাত্রীর জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন নিচেই এক মন্দির দেখে এগুই। দেখি সেটা ব্রাক্ষ্মমন্দির, পাশেই একটি দালান ব্রাক্ষ্মসমাজেরই।

আমি নিয়েছি চালকের পাশের আসন। চালকের নাম ওয়ানবোর থানকিউ, অনেকটা ওয়ান মোর থ্যাংক ইউ-র মতো। ভাবলাম ওর বিদঘুটে নামটি ঐ সূত্রেই মনে রাখবো। একটা জিনিষ অবাক করলো আমায়, ড্যাশবোর্ডে সে চ্যাপেল অব ডিভাইন মেরি, স্বামী বিবেকানন্দ, মা কালী, গৌতম বুদ্ধ একসারিতে পরপর রেখেছে; বিভিন্ন ধর্মের এক মিশোল, মনে হয় সকল দেবতাকেই তুষ্ট করতে চায় সে। পরে কথা বলে জানলাম সে বিশ্বাস করে মানবধর্মে, চায় সকল ধর্মের সম্মিলন ও সহাবস্থান। ড্যাশবোর্ডে একটি সোনালী প্রলেপ দেওয়া ছোট ঘণ্টা অবিরত ঘুরছিল, যেটা বৌদ্ধ প্যাগোডায় দেখা যায়। আমাদের দুই অচেনা সহযাত্রীর প্রথম জনের নাম জয়, পেশায় একাউন্টেন্ট, কিছুটা বাংলা জানে, বাড়ি আসাম। দ্বিতীয়জন মুন্না ভাগত, বিহারে বাড়ি। দুজনেই নীরব ও নিরামিষাশী, নির্লিপ্ত ও নিঃসংশয়।

গাড়ি ছাড়ল ৯ টা ত্রিশে। গুয়াহাটি যাওয়ার পর্যটকরা চলে গেছে ঢের আগে, যেন দিনটিকে বর্ধিত আকারে পায়। শিলং শহরের ঘিঞ্জি এলাকাগুলো ছাড়াতেই এক প্রাকৃতিক পথে নেমে আসে গাড়ি। পাহাড়ের কোল ঘেষে গেছে আঁকাবাঁকা পথ গেছে সরল সুন্দর। পথটি যে নবনির্মিত তা বোঝা যায় এর চেকনাই ও আধুনিক রূপ দেখে। ওপাশে দূরের পাহাড়ে কিছু ঘরবাড়ি, আর এপাশে পাইনের ঘন বন। সে বনের কাণ্ডসারির ভেতর দিয়ে হঠাৎ ঝিকমিক করে ওঠে এক জলরেখা। বুঝতে পারি পাহাড়ের নিচে রয়েছে এক হ্রদ। একটি জায়গা, সড়ক থেকে কিছুটা সরে গেছে, বেদীর মতো সেখানে দাঁড়িয়ে লোকেরা কী যেন দেখছে, বুঝি ঐ জলাশয়। দেখে আনচান করে ওঠে মন, অজান্তেই বলে উঠি, ‘গাড়ি রোক্কো, ওয়ান মোর।’


২.

গাড়িচালক ওয়ানবোর থানকিউ পথিপার্শ্বের ভিউপয়েন্টে গাড়ি থামানো মাত্র নেমে আসি আর দুটি সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি সেই উচ্চতায় যেখান থেকে দেখা যায় পাহাড়ের পাদদেশে শুয়ে থাকা এক মায়াবতী লেককে। এর নাম উমিয়াম। সে নামের নদীটিকে বাঁধ দিয়ে আটকে থাকা জলে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এই নয়নাভিরাম লেকটি। কে বলবে সে কৃত্রিম। দুপাশে পাহাড়ঘেরা জলাশয়টিকে প্রকৃতির দুলালী বলেই মনে হলো। পাহাড়ি উচ্চতা তার সমগ্র না হোক, যতদূর চোখ যায় জলের বিস্তৃতি, মাঝে মাঝে জেগে ওঠা চর তাতে বৈচিত্র্য এনেছে, ঠিক ওপাড়েই শুরু হওয়া পাহাড় শ্রেণি অনুচ্চ থেকে উচ্চ হয়েছে, স্পষ্ট থেকে ক্রমশ হয়েছে ধূসর, তৈরি করেছে এক অপূর্ব রহস্যময় দেয়াল যার রঙ কাছের সবুজ থেকে গাঢ় নীল হয়ে ধূসর নীলে মিশেছে। অমন দৃশ্য থেকে চোখ কি সরতে চায়? আমারো সরেনি, কিন্তু আমাদের যে যেতে হবে গুয়াহাটি। আমার দেখাদেখি নেমে এসেছেন আরেক নিসর্গভোজি মাহমুদ হাফিজ। গাড়িতে বসে থাকা নিরামিশাষী দুই সহযাত্রী আর চালকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে ভেবে দুজনেই ফিরে আসি, মনে মনে বলি আমরা আসবো, ফিরে আসবো ঠিকই, উমিয়াম লেক।

পথ গেছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, আঁকাবাঁকা তার চলা, কোথাও পাথর, কোথাও লাল মাটি, কোথাও মাটিপাথর, এই পথ তৈরি হয়েছে পাহাড় কেটে কেটেই। পাহাড় কেটে পথ বানানো সহজ কাজ নয়। আরও মুগ্ধ হই পথটি চার লেনের দেখে, মাঝে ডিভাইডারও আছে। আমরা তো সমতলের উপরেই চার লেন বানাতে এক যুগ পার করে দিয়েছি, আর এরা কি না পাথুরে পাহাড় কেটে ফোর লেন বানাল! বস্তুত শিলং থেকে গুয়াহাটি যাবার পথটি ছিল আমাদের জন্য অভাবিত। মনে হলো ইউরোপের পথঘাট। চারপাশের ভূপ্রকৃতি আর ঐ মানবিক নির্মাণ দেখে আপনি ভুলে যাবেন এটা ভারত না ইউরোপ, ভুল ভাঙবে যখন আপনি তাকাবেন কোন মানুষের মুখের দিকে, কিংবা মানুষের ঘরবাড়ির দিকে।

গাড়ি এসে পড়ে একটি সেতুর উপরে। আসলে এটি হলো সেই বাঁধ, যা থেকে সৃষ্ট ঐ লেক। নদীর উপর বাঁধ এক নান্দনিক দৃশ্যপট উপহার দেয়, হাত চলে যায় ক্যামেরার দিকে। ওয়ান মোর আমাকে সতর্ক করে এখানে ছবি তোলা নিষেধ। ভারতের সকল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রই জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত, অন্তত ভারত সরকার তাই মনে করে। তাই হে নিসর্গপ্রেমী, যতটুকু পারো ছবি তুলে নাও নিউরোনের সেলুলয়েডে, আর মহাকাশে ওৎ পেতে থাকা গুগল ভূ-উপগ্রহকে তার কাজ করতে দাও, ছবি সে-ই পাঠাবে।

সড়কের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে উমিয়াম লেক, নাকি আমরাই এসে দাঁড়িয়েছি সেই জলাশয়ের পাশে, নিজরূপে আত্মবিশ্বাসী রমণীর মতো যার 
উদাসীনতা অপার্থিব। তার দৈর্ঘ্য বিস্ময় জাগাচ্ছে। ছবি তুলতে পারছি না গাড়ির নিচু অবস্থানের জন্য, কাচের বাইরে সড়ককে ঘিরে রেখেছে অনুচ্চ সাদা দেয়াল, অবিচ্ছিন্ন নয় সে, বলা যায় বিচ্ছিন্ন স্লাবের এক সমাবেশ। তার ফোকর দিয়ে, তার ঘাড়ের উপর দিয়ে জলাশয়টি কেবল সৌন্দর্য আর প্রলোভন জাগিয়ে যাচ্ছে, নিরবে বলছে দেখে যাও, ছবি তুলো না। সেলুলয়েডে না পারো, শব্দে ফোঁটাও এই অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যছবি।

আমরা একটি জনপদে এসে পড়ি। এর নাম উমসনিং (Umsning)। চালক এর অর্থ বল্ল পানি কা বস্তি। শিলংয়ের লোকেরা উমিয়াম লেককে বলে বড়া পানি। সেই বড়া পানির প্রান্তে এই অঞ্চল, যখন প্লাবন নামে, নদী ফুঁসে ওঠে, যখন তাকে বাগ মানানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখন উমিয়াম লেকও ফুঁলে ঔঠে, এইসব জায়গা চলে যায় পানির নিচে। এজন্যই কি ঐ নাম? খাসি ভাষায় উম শব্দের অর্থ পানি।

যাহোক আছি ফুরফুরে মেজাজে, প্রতিটি সাইনবোর্ডে এলাকার নাম পড়ার চেষ্টা করি, আর পাহাড় ও পথ দেখে চলি। চালককে জিজ্ঞেস করি, সে কোথাও চা-পানের জন্য গাড়ি এই হাফ জাপানী গাড়ি থামাবে কি না। সে মাথা নাড়ে থামাবে। গাড়ি যেখানে থামল সেটা ছোট ভ্যালির মতো কিংবা সমতল। জিভা ভেজ (Jiva Veg) নামের রেস্তোরাঁটি সবুজ টাইলসের দোচালা দালান, সেই চাল নেমে এসেছে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের মতো, অনেক খাড়া আর দীঘল তার আকার। রেস্তোরাঁটিতে উঠতে হয় সিঁড়ি বেয়ে, অনুচ্চ সে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে নামছে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা। রেস্তোরাঁটি তাদেরই সরাইখানা, তাদের আধুনিককালের গাড়িরূপী ঘোড়াগুলো কাছের আস্তাবলে বাঁধা। তার মানে এই নয় যে আমরা সেখানে যেতে পারব না। মাহমুদ হাফিজ আমাকে নিয়ে গেলেন উল্টোদিকে। বল্লেন, আমি একটু অফবিট জায়গা পছন্দ করি। বুঝলাম সবুজ ছাদের নিচে বসে থাকা উত্তর ভারতীয় ফর্সা রমণীদের, মানে ঐ শিশুদের মায়েদের, আমার দেখা হবে না।

এপাশে এক উঠোনের মতো, সমুখেই এক বিটপী, সারি সারি দোকান, বেশিরভাগই খাবারের, চিপস আর বিস্কিট, পাউরুটি আর কেকে ভর্তি, আছে হস্তশিল্পের টুকিটাকি, কেননা এপথ দিয়ে প্রচুর পর্যটক যায়, দোকানসারির কোন কোনটি চায়ের দোকান তাতে অন্যখাবারও মেলে। একেবারে কোণারটিই সেরূপ, সেখানে এক খাসি তরুণীকে দেখে জিজ্ঞেস করি, চা মিলবে কি না? সে মাথা দোলায়, মিলবে। দোকানটি ভূমি থেকে একটু উপরে, বসবার জায়গাটি কাঠের খুঁটির উপর বসানো এক কাঠেরই পাটাতন, তাতে কাঠের টুলবেঞ্চি। ঐ পাহাড়ে অনেক গাছ, কাঠের অভাব নেই। সেখানে উঠি সিমেন্টের ক’ধাপ সিঁড়ি বেয়ে খাসি তরুণী ও চায়ের যুগপৎ আকর্ষণে। একটি কাঠের বেঞ্চিতে যুৎসই হয়ে বসেছি দেখি মাহমুদ হাফিজ দোকানসমূহ জরীপ করে ফিরছেন। আমরা ওপাশের পাহাড় দেখি, দোকানসারিতে ঝুলে থাকা দূর দূরান্তের কারখানার আলু চিপস ও বিবিধ বিস্কিটের চকচকে এলুমিনিয়ম ফয়েল, কাছের কয়েকটি খাসি মেয়েকে, বিশেষ করে কাজের মেয়েটির চা বানানো দেখি। সে নিজেই সকালের নাস্তা খাচ্ছিল, সেটা রেখে চলে গেছে চা বানাতে। এখানে দোকানগুলো চালাচ্ছে মেয়েরাই, ভারতের মাতৃতান্ত্রিক রাজ্য মেঘালয়ে সর্বত্র মেয়েদের উপস্থিতি।

সেখানে এসে বসে রাজস্থান থেকে মেঘালয় ও আসামে বেড়াতে আসা চার ব্যবসায়ী বন্ধু। এরা ডেনিমের ব্যবসা করে। আমরা বাংলাদেশের শুনে কৌতুহলী হলো, জিজ্ঞাসা করল, বাংলাদেশ কত দূরে। আমি খাসি তরুণির নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে ‘পূজা’। কাছের রাজস্থানী লোকটি বলে, এটা ওর আসল নাম নয়। ছদ্ম নাম। কী করে জানলো? আমি তো ঐ নামটিই সরলপ্রাণে বিশ্বাস করেছি। কিন্তু তিনি অভিজ্ঞ। এ সকল হাইওয়ের পাশে চা-দোকানে কাজ করা স্থানীয় যুবতীরা প্রতিদিন অসংখ্য বিদেশি বা ভিনরাজ্যের পুরুষের চোখের বৃত্তে এসে আঁটকে থাকে, ঐ প্রেমলোভী পুরুষেরা বেহুদাই নাম জিজ্ঞেস করে এদের খাসি নামগুলো তাদের কানে অপরিচিত ঠেকে, ঠিক ধরতে পারে না, তখন বারংবার জিজ্ঞেস করে শুদ্ধ নামটি উদ্ধারের প্রয়াস চালায় ( নাকি ঘনিষ্ঠ হবার?)। ঐসব ঝামেলা এড়াতেই খাসি রমণীগণ, যারা ভাবে বেগানা পূরুষদের নাম দিয়ে কাম কি, একটি সহজ শ্রোতৃসুন্দর, একবারেই বোঝা যায়- ছদ্মনাম ব্যবহার করে।

ফিরে এসে দেখি আমাদের গাড়ি ঠিক জায়গাতেই আছে কিন্তু চালক নেই। তখন দোকানসারির পেছনের পাহাড় ও জঙ্গলের পথটি ধরে হাঁটতে যাই। বেশিদূর যাই না, কেননা চালক ফিরলেই রওয়ানা দিতে হবে। দেখি পাহাড়ের আড়ালে চলে যাওয়া পথটি বেয়ে ঐ আড়াল থেকেই একদল বালক ও কিশোর বেরিয়ে আসছে, একজনের হাতে একটি ফুটবল। কতজন ওরা? গুণে দেখি ওরা এগারজন। আমাকে ছবি তুলতে দেখে খুশি হয়ে পোজ দেয়। কয়েকজন কাছে এসে দেখতে চায় কেমন উঠেছে ছবি। আমি দেখালে এ ওর দিকে আঙুল তুলে দেখায় ও শনাক্ত করে নিজেকে। দেখি ওয়ান মোর বেরিয়ে আসছে জিভা ভেজ থেকে। যাদের যাওয়ার কথা জিভা ভেজে তারা গেল অফবিটে, আর যার যাবার কথা অফবিটে, সে গেল কি না জিভা ভেজে? দুনিয়া পাল্টে গেছে। জানি না যাত্রী নিয়ে আসার জন্য জিভা ভেজ নামের চেইন রেস্তোরাঁটি চালকদের খাবারে ভর্তুকি দেয় কি না।

গাড়িতে ওঠার আগে আমরা চার সহযাত্রী ছবি তুলি। এখন আমরা আর কোথাও থামবো না, চলে যাব সোজা , আসামের রাজধানী গুয়াহাটি।

শিলং থেকে গুয়াহাটির দূরত্ব কাঁটায় কাঁটায় ৯৯ কিলোমিটার নয়, একটু বেশি, আমরা তাকে শত কিলোমিটার হিসেবে ধরতে পারি। এই পাহাড়ি পথটির নাম গুয়াহাটি-শিলং রোড, সংক্ষেপে GS রোড। পুরাকালে এ সড়ক কেমন ছিল কে জানে, অতীতেও তেমন ভালো ছিল না এর অবস্থা, সাম্প্রতিক সময়ে একেবারে নতুন ও আধুনিকরূপে তার সাজ, নতুন সহস্রাব্দের জন্য প্রস্তুত সে। পাহাড়ি পথ বলেই সে আঁকাবাঁকা, তবে মোটাদাগে টানলে শিলং থেকে সোজা উত্তরে গুয়াহাটি। এই পথ ধরে চলেছে আমাদের গাড়ি। কখনো পাহাড়ের কোলে গিয়ে চড়ে, কখনো কাঁখ বেয়ে নেমে আসে, বাহু বেয়ে উঠে, নেমে যায় করতলে, দুপাশের পাহাড়ের মাঝের শিরদাঁড়া বেয়ে চলে যায় উত্তরে। ট্রাফিক স্বাভাবিক থাকলে গাড়িতে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা। ডাউকি থেকে শিলং যেতে যত পাথুরে পাহাড় দেখেছি, শিলং থেকে গুয়াহাটি যেতে তত দেখছি মাটির পাহাড়। মাটি আছে বলেই পাহাড়গুলো গাছপালা আর গুল্মঘাসে ঢাকা সরস। প্রচুর বৃষ্টিপাত সেসব সবুজে ঢালে প্রাণ, চলে অবিরল স্নান। জিভা ভেজের পেছনে এক উদ্যানসম বনভূমি দেখেছি। তখন বুঝিনি, এখন গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে এক সুবিস্তৃত সবুজের উদ্যান যার নাম নংখিলেম বন্যপ্রাণী উদ্যান, ফুটবল হাতে বালকদল সেই উদ্যান থেকেই বেরিয়ে আসছিল, অনুমান করি সেখানে কেবল একটি নয়, একাধিক হরিৎবরণ ক্ষেত্র আছে বালক ও কিশোরদের উল্লাস হয়ে। গুগল দেখাচ্ছে অনতিদূরেই ছিল মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির একটি গির্জা।

খাসি ভাষায় উম অর্থ পানি। এই জিএস রোডে অনেক স্থানের নাম শুরু হয়েছে উম শব্দটি দিয়ে। সেই উমসিনিং থেকে শুরু করে উমরান (যেন উমরাও জান), উমদিহার (অনেকটা উমেদারের মতো) উমলিং প্রভৃতি। এই মহাসড়কের পশ্চিমে রয়েছে উমসো নামের সবুজ অরণ্য। পশ্চিমে আরো একটি জায়গার নাম উমডু। তো আমরা আছি উম বা পানির রাজ্যে।

আর পথে পথে মেলে বিভিন্ন নামের ধাবা, সেখানে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের খাবারের থালি পাওয়া যায়। উত্তর ভারতের ‘ধাবা’ ও ‘থালি’ সারাভারতেই ঐ নামে ছড়িয়েছে, এখন পূর্ব ভারতের পাহাড়ি পথে পথেও ধাবাগুলো থালি সাজিয়ে বসে আছে।

একটি বড় লোকালয়ে আসি। এর নাম নংপোহ। সমতলেই বিছানো জনপদ, বাণিজ্য আর বসতির সমারোহ। নংপোহ ছাড়াতেই কালো পাথরের পাহাড় অন্তর্হিত হলো, দেখা দিল লাল মাটির পাহাড়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে বিপুল ভূকম্পনে বেরিয়ে এসেছিল ভূ-অভ্যন্তরের আগুনে লাভা, জমাকৃত রূপে হয়েছিল আগ্নেয়শিলা
ঐ কালো পাথর; হাজার হাজার বছরে রূপান্তরিত হয়ে আগ্নেয়শিলা রূপ নিল পাললিক শিলায়, ঐ লাল মাটি। এ দুয়ের মাঝে পাহাড়ে পাহাড়ে রয়ে গেছে না পাথর, না মাটি রূপান্তরিত শিলা। নংপোহতে এক ছোট চায়ের দোকানে গাড়ি থামাল ওয়ানবোর, তবে চা খেতে নয়, পান খেতে। কঙ্গহে নামের এক যুবতী এসে দুটো পানের খিলি দিয়ে গেল। পাহাড়ে পান সুপারি চুন -সবই এন্তার পাওয়া যায়, পাহাড়ি মানুষেরা বেশ পানের ভক্ত। এরা পানের ভেতর নারিকেলের টুকরো গুঁজে দেয়। নারাং (Narang) নামের সমতলভূঁয়ে টোল প্লাজা। ওয়ানবোর টোল দিল ১০০ রুপি।গাড়ি নেমে এসেছে সমতলে, যদিও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেসব সমতল কয়েক হাজার ফুট উচ্চতায়। সমতলে নেমে আসতেই গরম আর ধুলা বেড়ে গেল।

আমরা এসে পড়ি বর্নিহাঁটে। সেই যে কবে শিলং ছেড়েছি, গাড়ি চলে এসেছে কত পথ, যতবার চালককে জিজ্ঞেস করি, এটা কোন রাজ্য, মেঘালয় না আসাম, সে গর্বিত উত্তর দেয়, মেঘালয়; যেন এক আধুনিককালের আলেকজান্ডার কেবলি বাড়িয়ে নিচ্ছে নিজ রাজ্যের সীমা, প্রতিপক্ষকে ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী’ ভাব তার। কিন্তু ঐ বর্নিহাঁটেই যে আসাম চলে এসেছে তা বুঝি সাইনবোর্ডে বাংলা হরফের মতো দেখতে অসমীয়া লেখা দেখে। এটা আসাম কিনা এই প্রশ্নে চালক মাথা নাড়ে, না এটা মেঘালয়। আসলে ঐখানে সড়ক এঁকে দিয়েছে দুই রাজ্যের সীমান্ত। এ পাশে মেঘালয়, ওপাশে আসাম, আর সড়কটি পড়েছে মেঘালয়ের ভেতরেই, ফলে অনেকদূর আসামের প্রান্ত ঘেষেই চলি, কিন্তু থেকে যাই মেঘালয়ে। দেখি চালকের অবয়বে একটা বিজয়ীর ভাব। যদিও গুগল ম্যাপ বলছে অতিকায় আসামের তুলনায় মেঘালয় ছোট। মেঘালয়ের এই অঞ্চলটির নাম, একটি পাহাড় স্তম্ভের মতো সে আসামের ভেতরে মাথা তুলেছে, কিংবা বলা যায় এক বিরাট পেরেক, দুপাশে আসামকাঠ রেখে তার উত্থান, আর ঐ জিএস সড়ক রয়ে গেছে মেঘালয়ের ভেতরেই, ফলে আসামের অনেকটা গভীরে সমান্তরাল গিয়েও, এমনকি জোরাবাত ছাড়িয়ে, যেখান থেকে একটি প্রধান সড়ক গেছে পূবের রাজ্য মণিপুরে, গাড়ি ও আমরা রয়ে যাই মেঘালয়ের চৌহদ্দীর ভেতর। ফলে আলেকজান্ডার ওয়ানবোরের বক্ষ স্ফীত হতে থাকে, তার রাজ্যজয়ের আকাঙ্ক্ষাও বেড়ে চলে।

বর্নিহাঁটে একটি পরিত্যক্ত কারখানা দেখলাম, কীসের কারখানা গাড়ির চালক বা সহযাত্রীরা বলতে পারল না, কোন সাইনবোর্ডও দেখলাম না। এরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজ রাখে না। শিলং ছাড়িয়ে, উমিয়াম লেক ছাড়িয়ে একটি সিমেন্ট কারখানা দেখেছিলাম। মেঘালয়ের পাহাড়ে বিবিধ খনিজপদার্থ রয়েছে, এখানে প্রচুর চুনাপাথর পাওয়া যায়। সিমেন্ট কারখানা তাই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক স্থাপনা।

একটা জায়গায় সাইনবোর্ডে বেশ বড় করে দুটি পত্রিকার নাম লেখা দেখলাম। এগুলো হলো দৈনিক অসম ও The Assam Tribune। প্রথম পত্রিকাটি ৫৫ বছরের পুরনো, দ্বিতীয়টি আরো বেশি, ৮৫ বছরের। কিছু বর্ণ ছাড়া অসমিয়া বর্ণমালা বাংলা বর্ণমালার অনুরূপ, ফলে সাইনবোর্ড পড়তে পারি। হাইওয়েতে দূরের সব গন্তব্যের নাম ও দূরত্ব লেখা। গুয়াহাটি যখন ১১ কিলোমিটার দূরত্বে, তখন বঙ্গাইগাঁও ২১৬ আর গোয়ালপাড়া ১৬৭ কিলোমিটার দূরে।

অবশেষে চলে আসি গুয়াহাটি, চিরকাল যাকে গৌহাটি বলে জেনেছি। মনে হলো চলে এসেছি বাংলাদেশের একটি অঞ্চলে, কারণ সাইনবোর্ডে বাংলা লেখা, হুবহু বাংলা নয় যদিও, বাংলার অনুরূপ, এক বাংলাপ্রতিম দেশে।

কামরুল হাসান
কামরুল হাসান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *