মোম্বাসা রাহা

ভোর পাঁচটা !

জোমো কেনিয়াত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্টের সামনে হাতে গোনা  আমরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছি । কেবলই নেমেছি নাইরোবি । লোকের আনাগোনা একদমই নেই । এতো সুনসান বিমানবন্দর ! 

লাগেজ হাতে পেয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম । এখনও পাঁচ ঘন্টা ! মূল গন্তব্যে এখনও পৌঁছাইনি।  বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দেখি বাইরে বেশ শীত , সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও পড়ছে । কর্তব্যরত গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলাম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর কোন দিকে ! অল্প কিছুদূর হাঁটার পরই পেয়ে গেলাম । বাংলাদেশ থেকে বাজেট ফ্লাইট এ এসেছি । সফর খুব আরামদায়ক হয়নি । আমার সমস্যা হয় না এগুলোতে । কিন্তু গৃহবন্ধু খুব সন্তুষ্ট হতে পারছেন না । তিনি আরও ভীত হয়ে আছেন সামনের সময়গুলোর জন্য । ভ্রমণ শুরুই হয়নি । পুরো ট্রিপ এখনো বাকি ।

আভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে একটি ক্যাফে পেলাম । যেখানে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম । তারপর কেনিয়া এয়ারলাইন্স এ চল্লিশ মিনিট উড্ডয়নের পর গিয়ে নামলাম আমার প্রতিক্ষিত শহরে ! অনেকেই বলেন মাসাইমারা গেম ড্রাইভের অভিজ্ঞতা না হলে কেনিয়া ভ্রমণ একেবারে অসম্পুর্ন ! কিন্তু আমি মনে করি কেনিয়ার নীল-সাদা শহর ভ্রমণ না করে কেনিয়া ত্যাগ করা উচিত নয় ।

বিভূতিভূষণ যে শহরে ভ্রমণ না করেই কল্পনায় এঁকেছেন স্বপ্নের শহর মোম্বাসা। ছেলেবেলায়    “চাঁদের পাহাড়” পড়তে পড়তে আমিও নিজস্ব কল্পনায় মোম্বাসার অবয়ব তৈরি করেছি । সেটি মিলিয়ে দেখবার সুযোগ হাতছাড়া করি কি করে !

মোম্বাসার মই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে গিয়ে নামলাম। নেমেই চোখে পড়ল একটি লেখা “কারিবু মোম্বাসা রাহা”। অর্থ হলো আনন্দপূর্ণ মোম্বাসাতে স্বাগতম। আমাদের পূর্ব আফিকা ভ্রমণ সঙ্গী কেনিয়ার ভূমিপুত্র জিসুকী ফ্রান্সিস দূর থেকেই হাত নেড়ে অভিবাদন জানালো। জিসুকির গাড়িতে হোটেল অভিমুখে যাত্রা করলাম। জিসুকি বললো ৫০ মিনিটের ড্রাইভ এখান থেকে। সেই যে রওনা করলাম দেশ থেকে , এখনও পথেই রয়েছি!কিছুদূর যাবার পর পথে খেয়াল করলাম কিছু মাইক্রোবাস চলছে এবং মাইক্রোবাস গুলো নানান রঙ ও ছবিতে রাঙানো। আমি জিজ্ঞাসা করবার আগেই জিসুকি বললো এই বাহনের নাম মাটাটু। এটিই শহরের গণ পরিবহণ । আরও গভীর ভাবে খেয়াল করে দেখলাম, বেশির ভাগ মাইক্রোর দরজা খোলা। হয়তো এটি আমাদের দেশের কিছু এলাকার সিএনজি কিংবা ট্যাম্পুর মত ব্যবহার হয় ।  

বাক্স পেটরা নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করতে করতে দুপুর ১২টা হলো। পরিকল্পনা ঠিক হলো, ফ্রেশ হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে দুপুরে খাবার খাবো, তারপর জিসাস ফোর্ট ।

গুগলের কল্যানে এখন সিবকিছু হাতের মুঠোয়। এখন আর মানস ভ্রমণ করতে হয় না।একটি ক্লিকে প্রত্যাশিত স্থানের অগণিত ছবি/ভিডিও উপভোগ করা যায়। কিন্তু আমি গন্তব্যে যাবার পুর্বে গুগল চর্চা কম করি । সেই ১৯৯৯ সালে প্রথম নেপাল ভ্রমণ আর প্রথম উড়োজাহাজে চড়ে বসা, অজানাকে জানা,অদেখাকে দেখার স্বাদ এখনও নিতে চাই।তবে ভ্রমণের প্রাক্কালে প্রচুর বই পড়ি । তাই ফোর্ট জিসাস ভ্রমণ লিস্টে দেখেছি কিন্তু গুগল খুলিনি ।

ফোর্ট জিসাস

কথা মত, শহরের ভেতরে একটি রেস্তরাঁয় দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর ফোর্ট জিসাসের উদ্দেশ্যে। গাড়ি একটি নির্দিস্ট স্থানে এসে থামলো। চারদিকে স্যুভেনির দোকান,লোকজনের হাক-ডাক দেখে বলে দেবার দরকার হলো না কোন জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রের সামনে পৌঁছে গেছি। নেমেই দেখতে পেলাম ফোর্টের সাদামাটা কিন্তু উঁচু দেয়াল। প্রবেশ মুখেই দুটো ছোট কামান প্রতিস্থাপন করা রয়েছে। কিছু লোকজন কামানের উপরে বসে আছে। দেখে মনে হলো স্থানীয় পর্যটকই হবেন। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম কামান দুটি খালি হলে ছবি তুলে রাখবো। কিন্তু আশার গুঁড়ে বালি।এশিয়া কিংবা আফ্রিকার পর্যটকরা মনে হয় নিজ দেশের প্রত্নস্থল সম্পর্কে সচেতন নয়। প্রথম বিশ্বের দেশ গুলোতে এরকম চিত্র দেখা যায় না ।

চলাচলের রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে নির্মিত হবে যে কোন দুর্গ এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। হেঁটে উঠছি উপরে এখনও মুল প্রবেশদ্বার আসেনি। সামনেই আরও একটি কামান দেখতে পেলাম ।আমার কামান প্রীতি রয়েছে। এই রকম ভালো লাগা কাজ করে কোন এলাকার পুরনো পোস্ট অফিস, রেলওয়ে স্টেশন সহ আরও নানাবিধ বিষয়ে ।

এখন দেখা পেলাম সিংহ দুয়ারের । আমাদের রেখে জিসুকি টিকিট ঘরের দিকে গেলেন । টিকেট ঘরের পাশেই বড় বড় বোর্ডে এই দুর্গের ইতিহাস লেখা রয়েছে । আমি কেবলই পড়া শুরু করেছি জিসুকি এসে বললো “Eliza we need to proceed , you can read it , when we will come back ”। আমি বাধ্য পর্যটকের মত জিসুকির পিছু নিলাম। সামনে যেতেই একটি তরুণী আমাদের অভিবাদন জানালো। নিজের নাম বললো ক্যাথরিন মুটুকু। ক্যাথরিন আমাদের ফোর্ট জিসাসের গাইড। সামনের দুই ঘন্টা ক্যাথরিন আমাদের ভ্রমণসংগী ।

ক্যাথরিন এর পিছু পিছু যাচ্ছি আমরা সবাই।আমার চোখ শুধু চলে যাচ্ছে দুর্গ চত্বরে পড়ে থাকা ছোট বড় কামান গুলোর দিকে। আমার সাথীরা এগিয়ে যাচ্ছে,কিন্তু আমি বেশ খানিকটা পেছনে থেকে যাচ্ছি কামানের ছবি তুলতে গিয়ে ।

এই দুর্গের ইতিহাস যতটুকু জেনেছি , পুর্তগীজরা নির্মান করেছিল এই দুর্গ । আমার আগ্রহের জায়গা হলো , নাম কেন জিসার্স ফোর্ট !ক্যাথরিন এর ভাষ্য মনে নির্মান শৈলীর জন্যই এরূপ নামকরণ । মনুষ্য দেহের আদলে মূলত যীশুর দু’বাহু প্রসারিত অবস্থায় যেরকম অবয়ব তৈরী হয় , সেরকমই এই দুর্গের গঠন । ক্যাথরিন দুর্গের চারধার দেখিয়ে এর অবয়ব ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করছিল । আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সে আমাকে নিয়ে গেল দুর্গের একটি ছবির স্কেচ দেখাতে । ছবি দেখবার পর আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম ।

পনের শতকের শেষ দিকে ভারত মহাসাগরের তীর ঘেঁসে মোম্বাসা নামক এই অঞ্চলে পুর্তগীজরা নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে ঘাঁটি স্থাপন করে । আরবরা তখন এই অঞ্চলে দাস ব্যবসায় মত্ত । কথিত রয়েছে ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পুর্তগীজরা মোম্বাসাতে আসে এবং ঠিক ১০০ বছর পর মোম্বাসা দখল করে নেয় । জিসাস ফোর্ট ছিল পুর্তগীজদের সামরিক দুর্গ ।

পুর্তগীজরা মোম্বাসা দখল করলেও পুরোপুরি আয়ত্বে নিতে পারেনি। সেসময় মোম্বাসাতে দফায় দফায় যুদ্ধ চলতেই থাকে। পুর্তগীজরা এই দুর্গে নির্মান করে গোলা বারুদ মজুতের স্থান, সৈন্যদের আবাসস্থল, গীর্জা আরও নানা কিছু। সব কিছুর ধ্বংসাবশেষ দুর্গের চত্বরে এখনও বিদ্যমান ।

পুর্তগীজ ও আবরদের এরকম যুদ্ধ বিগ্রহ চলতে চলতে আরবরা আবার এই দুর্গ দখলে নেয়। মূলত ওমানীরা এখানে বসতি স্থাপন করে। ঘুরতে ঘুরতে ক্যাথরিন একটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। পাশাপাশি দুটো কাঠের কারুকাজ করা দরজা। পুরো মোম্বাসাতে এই দুটি ওমানী দরজা টিকে রয়েছে। ওমানীরা গীর্জা ধবংস করে। দরজার পাশেই ছিল নামাজের স্থান। আরও কিছুদুর গেলে কয়েকটি গোপন কুঠুরি দেখতে পেলাম। এই কুঠুরি গুলো নাকি ভারত মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত ছিল ।

প্রাচীন প্রবাল পাথরের এই দুর্গের ধ্বংসাবশেষই এত মোহনীয়। পনের/ষোল শতকে মহাসাগরের পাড়ে বিশাল এই দুর্গ কেমন লাগতো দেখতে। আহা ! কতই না সমৃদ্ধ ছিল এই অঞ্চল । ওমানীরা আরও ১০০ বছর শাসন করে মোম্বাসা । তখন ভারত থেকে ও আরবের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ওমানীরা বিভিন্ন কাজে নানা জীবিকার মানুষ মোম্বাসাতে নিয়ে আসে। মোম্বাসার সমৃদ্ধির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ব্রিটিশদের নজরে আসে মোম্বাসা ।

আফ্রিকার কোনো দুর্গই ফোর্ট জেসাসের মতো এতটা অশান্তির মধ্যে পড়েনি।১৬৩১ থেকে ১৮৭৫ পর্যন্ত ফোর্ট জেসুস বেশ কয়েকবার হাত বদল করে, পর্তুগিজ, আরব সৈন্য, আফ্রিকান সোয়াহিলি যোদ্ধা এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের দ্বার । দুর্গের নিয়ন্ত্রণের জন্য যুদ্ধগুলি ভয়ঙ্কর ছিল কারণ যে কেউ দুর্গটি দখল করেছে সে ক্রমবর্ধমান শহর মোম্বাসা এবং ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য পথের সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছে।

১৮০০ শতকের দিকে আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চল শাসন করতে শুরু করে ইউরোপিয়ানরা। ১৮৯৫ সালে কেনিয়া পুরোপুরি কেনিয়ার দখলে চলে যায়। কেনিয়ার নামকরণের গল্প ক্যাথরিন বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলছিল। মাউন্ট কেনিয়ার প্রাচীন নাম ছিল কিরিনইইয়াগা। ব্রিটিশদের উচ্চারনের সুবিধার জন্য নাম হয় কিনিয়া , সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে হয় কেনিয়া। ব্রিটিশরা মুলত এই দুর্গ ব্যবহার করে কারাগার হিসেবে। কয়েকটি স্থাপনা দেখিয়ে ক্যাথরিন বললো এগুলো কারাগার ছিল, এরকম একটি ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম ছোট একটি জানালা রয়েছে কেবল তাও বেশ উঁচুতে।

বর্তমানে দুর্গটি প্রায় ৩ হেক্টর জায়গার উপর অবস্থিত, দর্শনার্থীদের বেঁচে থাকা কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে পারেন, যার মধ্যে পর্তুগিজদের দ্বারা বৃষ্টির জল সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত একটি খোলা জলের কুন্ড, পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত একটি গির্জার ধ্বংসাবশেষ এবং আরবদের দ্বারা নির্মিত ২৩ মিটার গভীর কূপ।

দুর্গটির নকশা করেছিলেন জিওভান্নি বাতিস্তা কাইরাতি, একজন ইতালীয় স্থপতি। ১৫৯৩ সালের এপ্রিলে দুর্গটির নামকরণ করা হয় “ফর্তালেজা দে জেসুস ডি মোম্বাকা”।

ঘুরতে ঘুরতে এলাম পুর্তুগিজ সৈন্যদের দেয়ালচিত্র দেখবার জন্য। পাঁচ শত বছর  আগের দেয়ালচিত্র এখনও জ্বলজ্বল করছে। সেখান থেকে কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলেই দুর্গের শেষ দেয়াল। যেখানে দেয়ালের ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে কামান তাক করানো রয়েছে মহাসাগর মুখি। পাশেই একটি মিনার, মানে ওয়াচ টাওয়ার। দেয়ালের বাইরে তাকালেই নীল জলরাশি।

গান প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে সামনে একটি স্থাপনা দেখতে পেলাম। ক্যাথরিন বললো এটি মিউজিয়াম , কিন্তু এখন বন্ধ রয়েছে। সংস্কার কাজ চলছে । কিন্তু এই স্থাপনার সামনে লাইন ধরে এমাথা ওমাথা জুড়ে কামান রয়েছে । ক্যাথরিনের কাছে জানতে চাইলাম কতগুলো কামান রয়েছে এখানে । ক্যাথরিন জানে না । তারপর দুজন মিলে গুনে দেখলাম ২৬টি । পুরো চত্বরে টিকে থাকা কামানের সংখ্যাও ক্যাথরিন বলতে পারেনি ।

এই চত্বরে একজন নারী পুর্তগীজের কংকাল পাওয়া গেছে। গবেষকরা ধারনা করেছেন তিনি গীর্জার সেবিকা ছিলেন। আচমকা জিসুকী বলে উঠলো “ এলিজা তুমি কুইনাইন গাছ দেখেছ কখনও “? আমি না-সুচক মাথা নাড়লাম। হায় সেই কুইনাইন! ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক! আমাদের সাহিত্যে কুইনাইনের ঔষধ এর কত উল্লেখ শুনেছি । পুরোনো পত্রিকাতে কুইনাইনের কত বিজ্ঞাপন দেখেছি। কুইলাইন গাছের পাশেই একটা প্রকান্ড তিমির কংকাল। তিমি তো প্রকান্ডই হবে! কুইলাইন গাছের তলায় একটি কাঠের বেঞ্চ দেখতে পেলাম । সেখানে খানিকক্ষন জিরিয়ে নিলাম। অনেক হেঁটেছি।

জিরিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। আবারও সারিবদ্ধ কতগুলো কামান। একটি কামানের নল থেকে ক্যাথরিন কয়েকটি গোলা বের করলো। সাবধান করে দিলো এক হাত দিয়ে না তুলতে। আমি কিছুটা চেস্টা করে দেখলাম, ও বাবা, কব্জি খুলে যাবার উপক্রম। এক একটি গোলা ২০ কেজি ওজনের ।

প্রায় ফুরিয়ে এলো জিসাস ফোর্ট পরিভ্রমন । সঙ্গত কারনেই  জিসাস ফোর্ট ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত ।  আমি ক্যাথরিনকে বিদায় জানাতে চাইলাম , জিসুকি জানালো আজ সন্ধ্যা অবধি ক্যাথরিন আমাদের সাথে থাকবে । আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ফোর্টের দুই ঘন্টার সাথী ক্যাথরিন ।  

হেরিটেজ ওয়াক অব ওল্ড মোম্বাসা

দুর্গ ঘুরতে ঘুরতে ক্যাথরিন বুঝে গেছে আমার কামান প্রীতি । ফোর্ট থেকে বেরিয়ে ক্যাথরিন আমাকে অন্য একটি চত্বরে নিয়ে গেল। খুব ভীড় সেখানে স্থানীয়রা বিকেলের হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। ভীড় ঠেলে সেখানে দেখতে পেলাম একটি বন্ধুক রাখা রয়েছে চাকার উপরে।

এটি এইচ এম এস পেগাসাসের একটি বন্দু । পেগাসাস একটি  ২০০০ টন ওজনের ক্রুজার যা ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাঞ্জিবার বন্দরে বয়লার মেরামতের কাজ করছিল তখন একটি জার্মান যুদ্ধজাহাজ কোনিগসবার্গ এর সাথে সংঘর্ষে ডুবে যায় ।

এখানে রাখা বন্দুকটি আটটির মধ্যে একটি, যা জাহাজ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এবং পরে চাকায় বসানো হয়। দুর্গের বাইরে এই স্থানটিতে একটি অবেলিস্ক নির্মান করা হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈন্যদের সম্মান স্মারক হিসেবে ।

তারপর শুরু হলো আমাদের “হেরিটেজ ওয়াক”। হেঁটে হেঁটে পুরোনো মোম্বাসাকে অনুভব করবার সময় ক্যাথরিন প্রথমে নিয়ে গেল মোম্বাসা শহরের প্রথম পোস্ট অফিসের সামনে। পোস্ট অফিস এখন আর কার্যকরী নেই। কিন্তু স্মৃতি হিসেবে রাখা হয়েছে। এই পোস্ট অফিসের নির্মাণ কাল ১৮৯৯ অব্দ।

অলি গলি ঘুরে বেড়াচ্ছি আর পুরোনো আধ ভাংগা বাড়ি গুলো দেখছি। কাঠের ঝুল বারান্দা কিংবা নির্মান শৈলী দেখে কোনটা মনে হচ্ছে পুর্তগীজদের নির্মিত , কোনটা ঠেকছে ব্রিটিশ । ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম একটি বাড়ির সামনে লেখা রয়েছে আফিকার প্রথম হোটেল, প্রতিষ্ঠাকাল ১৯০১। ক্যাথরিন একটি ত্রিতল স্থাপনা দেখিয়ে বললো এটি মোম্বাসা শহরের প্রথম হাসপাতাল। কথিত আছে একজন ভারতীয় এটি নির্মান করেছেন । আমি আর ক্যাথরিন গল্প করছি আর চারদিকে দেখছি । জিসুকি আর আমার গৃহবন্ধুর বেশ মন্থর গতিতে চলছেন । সেই সময়ের মসজিদ , গীর্জা এখনও রয়ে গেছে।একটি বিষয় ভালো লাগলো বিশেষ বিশেষ বাড়ি গুলোর সামনে ছোট একটি বোর্ডে ইতিহাস লেখা রয়েছে । তাই যে কেউ হেঁটে গেলেই ইতিহাস জানা সম্ভব । আমাদের ঢাকার অল্ড টাউনে এই রীতি অনুসরণ করা যেতে পারে।  

জিসুকি মনে করিয়ে দিল , কেনিয়ার উপকূলীয় শহর মোম্বাসা পরিদর্শন কখনই সম্পূর্ণ হয় না যতক্ষণ না কেউ আইকনিক মোম্বাসা টাস্কগুলি দেখতে পান ।  ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে টাস্ক দুটি । সুতরাং সন্ধ্যে হবার পুর্বে সেখানে যেতে হবে আমাদের।

মোই অ্যাভিনিউতে অবস্থিত, যা পূর্বে কিলিন্দিনি রোড নামে পরিচিত ছিল  । এই সড়কটি মোম্বাসা বন্দরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে ।  টাস্কগুলি মোম্বাসার সমৃদ্ধ ইতিহাসে একটি ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠেছে । বিখ্যাত ল্যান্ডমার্কটি ১৯৫২  সালে রানী এলিজাবেথের মোম্বাসা সফরের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল।

তারপর ধীরে ধীরে মহাসাগরের পাড়ে গেলাম । এ তো মহা ভীড় । মেলা পদের স্ট্রিট ফুড।কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবো । আলুর মেলা ধরনের ফ্রাই দেখলাম। নানা ফল ফলাদি তো রয়েছেই । তখন সুর্য পশ্চিমে কেবল ঢোলে পড়েছে । চারদিকে আল আভা তখনও বিরাজমান । রাস্তার ধারেই বেশ কয়েকটি প্রকান্ড গাছ দেখতে পেলাম । পরিচিতও লাগছিল কিন্তু নাম মনে করতে পারছিলাম না । গাছ গুলোর কান্ডে পাতার সংখ্যা কম কিন্তু বেশ বড় বড় ফল ঝুলে রয়েছে গাছে । ক্যাথরিন এর কাছে জানতে চাইলাম গাছ গুলো সম্পর্কে ।

যে গাছের জন্ম হয়েছে স্বর্গে !

তাই নাকি ? বাওবাব ! কি বলে বাওবাব ! আফ্রিকার সেই বিখ্যাত বাওবাব গাছ , যার জন্ম হয়েছে স্বর্গে ! আমি কেন দেখে চিনতে পারলাম না । তারপর পূর্ব আফ্রিকার তিন দেশের যেখানেই গেছি , সেখানেই দেখি ছোট বড় বাওবাব গাছ !! বাওবাব গাছের উপকথা গুলো জেনেছি জিসুকী আর ক্যাথরিনের কাছে যা জেনেছি তাই অল্প করে তুলে ধরছি । 

স্বর্গে চমৎকার সুন্দর একটি গাছ ছিল । শয়তানের মাথায় তো বাজেবুদ্ধি গিজগিজ করে। সে তখন স্বর্গেই থাকতো। শয়তান যখন অত সুন্দর গাছটিকে দেখলো, একদিন সুযোগ বুঝে গিয়ে গাছটিকে উপড়ে ফেলল । তারপর সেটাকে পৃথিবীতে এনে ডালপালা শুদ্ধ মাটির গভীরে উল্টো করে পুঁতে ফেললো। আর শিকড়গুলো রয়ে গেলো মাটির উপরে। বেচারা গাছ! উল্টো হয়েই রইল অমন। গল্পটি সত্য কি মিথ্যা জানি না । তবে গাছটি কিন্তু সত্যি।

আফ্রিকার যে কোন অঞ্চলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেই হবে , বাওবাব গাছ দেখবো । হয়তো তার বাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বাওবাব । বাওবাব গাছ নিয়ে উপকথার অন্ত নেই । বাওবাব গাছের আদি নিবাস আফ্রিকা, আরব এবং অস্ট্রেলিয়াতে । পাওয়া যায় ভারতের কয়েকটি অঞ্চলেও। মাদাগাস্কারে বাওবাব গাছকে ‘টি পট ট্রি’ বলে, কারণ কান্ডের সাথে চায়ের কাপের অদ্ভুত মিল। অস্ট্রেলিয়ায় একে বলে দ্য প্রিজন ট্রি , মানে জেলখানা গাছ!

বছরের অধিকাংশ সময়ে এই গাছে কোনো পাতা থাকে না। তখন মৃত গাছ বলে ভ্রম হয়। গ্রীষ্ম শেষে নতুন পাতা গজায় বাওবাব গাছে। পাতা না থাকলেও এরা কান্ডের ভেতরে খাদ্য এবং পানি সঞ্চয় করে রাখে। খাদ্য-পানি সঞ্চিত হতে হতে কান্ডটি ব্যারেলের মতো মোটা হয়ে যায়।

এই গাছের কান্ড থেকে তৈরি হয় দড়ি ,বাদ্যযন্ত্রের তার । বাওবাব ফল দুগ্ধজাত খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর ফল দিয়ে তৈরি হয় দারুণ এক জুস। বীজ থেকে তৈরি হয় তেল, সৌন্দর্যচর্চায় যার দারুণ চাহিদা রয়েছে। ভেজে খাওয়া যায় বীজ। ফলের খোসা থেকে তৈরি হয় পাল্প এজেন্ট। এদের পাতাও ফেলনা নয়। দারুণ স্বাদের চাটনি তৈরি হয় এদের পাতা সিদ্ধ করে।

বাওবাব গাছের কথা প্রথম জেনেছি বিভূতি ভূষণের ভ্রমণ উপন্যাস চাঁদের পাহাড় পড়ে । নিশ্চয়ই অনেকে জানেন ঢাকাতেও রয়েছে বাওবাব গাছ । আমি প্রথম বাওবাব গাছ দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সামনে ২০১৯ সালে । পত্রিকা পড়ে দেখতে গিয়েছিলাম । এখনও টিকে রয়েছে কি না জানি না । পুর্ব আফ্রিকা ভ্রমণের পর মনে হলো , আচ্ছা আমাদের বাওবাব গাছটি কেমন আছে ! সময় করে গিয়ে দেখে আসবো ।

দিন তো ফুরিয়ে গেল ! কাল ভাস্কো দা গামা পিলার দেখতে যাবো । আমি আগে পড়েছিলাম ভাস্কো দা গামা প্রথম নোঙর করেন মোম্বাসা শহরে কিন্তু আসলে তা নয় ।ভাস্কো-দা-গামা কেনিয়ার ভারত মহাসাগরের পাড়ে, মালিন্দি শহরে এসে প্রথমে জাহজ ভিড়ান ।  স্থানটি মোম্বাসা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে। মোম্বাসাতে জাহাজ ভিড়াতে ব্যর্থ হয়ে এই অঞ্চলের ওমানি সুলতানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং এখানে কিছুদিন থাকবার অনুমতি প্রার্থনা করেন, ১৪৯৮ অব্দে।

ও হ্যাঁ , ক্যাথরিনের পুরো পরিচয়টা বলতে চাই একটি বিশেষ কারণে । ৫ ঘন্টা ক্যাথরিনের সাথে কেটেছে। ক্যাথরিন ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্টে গ্রাজুয়েশন এর দ্বার প্রান্তে রয়েছেন। কেনিয়া জাদুঘরের আন্ডারে সে ইনটার্ন হিসেবে কাজ করছেন।

পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে এরকম কত পর্যটন শিল্পে কাজ করা তরুন-তরুনীর সাথে আমার দেখা হয়েছে, গল্প হয়েছে। কারো কারো সাথে এখনও যোগাযোগ রয়েছে। এদের দেখি আর ভাবি আমাদের সমাজ কিংবা রাস্ট্র কবে পর্যটন শিল্পে আগ্রহী তরুন তরুনীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে, কবে তাদের উৎসাহ যোগাবে।

মোম্বাসার আরো অনেক গল্প বাকি রইলো কিন্তু । অন্য কোন অবসরে সে গল্প গুলো অবশ্যই বলবো । শিরোনামের মোম্বাসা রাহা কথাটির অর্থ হলো আনন্দের মোম্বাসা । রাহা একটি সোয়াহেলি শব্দ । কে কবে মোম্বাসার এরূপ নামকরণ করেছে তা জানা হয়নি । 

এলিজা বিনতে এলাহী
এলিজা বিনতে এলাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *