মাউন্ট রেইনিয়ার

ক্রিস্টাল মাউন্টেনের সাত হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে আকস্মিক আমার গা কাঁপছে। সামিট হাউসের ইলিশিয়ান ডেস্ক থেকে ব্লুবেরি সিডার কিনে এই আকাশরেখাতেই পাতা টেবিলসারির একটা জুড়ে বসেছি। অন্য টেবিলেগুলোতে নানাদেশের পাহাড়প্রেমী পর্যটকের খানাপিনার টুংটাং। আমার সঙ্গীরা তখনও স্যান্ডউইচ ও বিফ র‍্যাপ সংগ্রহের লাইনে। আটাত্তর ডলার দাম একসঙ্গে চুকানো হলেও সিডার ক্যানটি কাউন্টার থেকেই আগে হাতে পেয়েছি, অন্য আইটেম বানিয়ে দেয়া হবে বলে সময়সাপেক্ষ। আমার তর সইছে না। তবিয়ত ঠিক রাখতে দ্রুত রক্তস্রোতে কিছু চালান করে দেয়া প্রয়োজন।  ক্যানটি ডাবল সাইজ বিয়ারের মতো, মাত্রাও সাত শতাংশের মতো। পাহাড়শীর্ষে জীবন বাঁচাতে আর কিছু করার নেই। ক্যানটি খুলে যখন চুমুক দিতে যাবো, তখনই কুট্টুস শব্দ করে এক পাহাড়ি পাখি এসে টেবিলে হাজির। একদম হাতের কাছে। আমাদের দোয়েলের চেয়ে ছোট, চড়ুইয়ের চেয়ে বড়, টুনটুনি সাইজের। ভদ্রগোছের শান্তপাখি। এখানে নাম উইলো ফ্লাইকাচার। মনুষ্যভীতিকে তোয়াক্কা না করে আদুরে ভঙ্গিতে ফুরুৎ করে উড়ে কাছে এসেছে। মনে হলো সেও খাবারের খোঁজে হন্যে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টের পেলে এতো উচ্চতায় বাস করা পাখির ওপর প্রামাণ্যচিত্র বানিয়ে ফেলবে নিশ্চিত। 

ওয়ানটাইম গ্লাসে খানিকটা মিস্টি সিডার ঢেলে উইলোকে  দিতে যাচ্ছি, এমন সময় পাশের নোটিশবোর্ডের দিকে শাহাদত আঙুল উঁচিয়ে সতর্ক করলো মধ্যবয়স্ক রেস্তোরা কর্মী। নোটিশে লেখা’ হিউম্যান ফুড ক্যান বি ডেডলি ফর হাই অলডিচ্যুড ক্রিটার্স, ডন্ট ফিড দেম, ইভেন ইফ দে বেগ। কথা পরিস্কার। আমি পাত্র সরিয়ে পাণীয় না ঢেলে  লম্বা একটা চুমুক দিই। বিয়ারের স্বাদ তিতা হলেও এটা মিষ্টি। টাইটন সিডার ওয়ার্কস কোম্পানি  ইয়াকিমা উপত্যকার নিজস্ব খামারের তাজা ফল থেকে তৈরি করেছে মহার্ঘটি। গুনাগুণ ও ফুডভ্যালুর কথা লেখা আছে ক্যানের গায়ে। কয়েক চুমুকে থাতস্থ হই। পাখিটি ফুরুৎ করে হাতের নাগালেই ঝাওগাছের ডালে বসলে আমি পরিচ্ছন্নকর্মীর দিকে মনোযোগ দিই। আজন্ম অকর্তিত শ্রুশ্মুগুম্ফওলা মধ্যবয়স্ক রেস্তোরাকর্মী টকটকে ফর্সা ও নাদুসনুদুস। যেসব পাহাড়প্রেমী প্রচুর টাকা খরচ করে গন্ডোলাচেপে বা পাহাড় বেয়ে মাউন্টেন সামিটে পৌঁছেছে, তাদের কারও চেয়ে চেহারাসুরত তার কম নয়। এমনকি চোখেমুখে শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তি ও আভিজাত্যের ছাপ। খাকি রঙের ইউনিফর্মধারী লোকটি বিশেষ ধরনের হাতানি দিয়ে টেবিলের  উচ্ছ্বিস্ট সরাচ্ছে। মনে হলো, সে এখানে গোয়েন্দাগিরি করছে, নয়তো পাহাড়প্রেমে বুঁদ হয়ে আমাদের মতো ঘুরতে এসে এই চাকরি যেচে রয়ে গেছে।  আমি মেলাতে পারি না। ভাবি, কতো রঙের মানুষ আছে এ জগতে!

জনপ্রিয় লেখক ব্রাজিলিয়ান পাওলো কোয়েলহো’র তীর্থভ্রমণমূলক বেস্টসেলার ‘পিলগ্রিমেজ’ এর যে কপিটি মার্কিন মুলুকে এসে হাতে পেয়েছি, এর প্রচ্ছদ ক্যাসেকডেময়, পুঞ্জপাহাড়ের সন্নিবেশ। আগে ডাউনটাউনসহ নানা দ্রষ্টব্য আমাদের দেখা হয়ে যাওয়ায় সিয়াটলে আমাদের সাময়িকবাসের গৃহকর্তা পল ওয়াশিংটন স্টেটের বিভিন্ন ওয়ান্ডার ও পর্যটকপ্রিয় এলাকাগুলোতে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। আমাদের সিয়াটলবাস ও পর্যটন যাতে আরামদায়ক হয়,ভ্রমণপ্রিয়চোখে সুখকর হয়,সেজন্য  পল-জেরিন দম্পতির রাতের আরাম হারাম হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আজকের লংড্রাইভ ক্রিস্টাল মাউন্টেন। পাওলো কোয়েলহোর পিলগ্রিমেজ এর প্রচ্ছদ সে আগ্রহকে উস্কে দেয়। আমি ত্বরিত সায় দিয়ে গাড়িতে উঠে বসি।  লিনউড এর বাসা থেকে রওয়ানা দিতে দিতে বেলা বারোটা। ক্রিস্টাল মাউন্টেনের গন্তব্যে দুই সোয়া দুইঘণ্টা লাগবে। আবহাওয়া সকাল থেকেই রৌদ্রকরোজ্জ্বল।

লিনউড থেকে ডামসন রোড দিয়ে বেরিয়ে এই ড্রাইভ ৫২৪ ও ৫২৭ সড়ক ধরে ছুটে  চলে গাড়ি। ক্যানিয়ন পার্ককে বাঁয়ে রেখে বৃত্তাকার একটি চক্কর দিয়েই উঠে পড়ি  ফ্রি ওয়ে ফোর ও ফাইভে। এখানকার ড্রাইভে এই এক মজা। ফ্রি ওয়েতে উঠলে থামার নাম নেই। এক্সিট দিয়ে আঞ্চলিক রাস্তায় নামার আগে শুধু ছুটে চলা। বিরতিহীন, উচ্চ গতিময় ফ্রি ওয়েতে ড্রাইভের রোমাঞ্চই আলাদা। মার্কিনীরা দূরত্ব বোঝাতে মাইল-কিলোমিটারে না বলে ঘণ্টা মিনিটের সঙ্গে ড্রাইভ শব্দটি যোগ করে । আমি ভোতো বাঙালি। মাপের ফিতায় দূরত্ব না বললে মাথায় ঢোকে না আমার।  গুগলিং করে দেখছি, যেতে হবে দেড়শ’ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে আমার জন্মস্থান কুমারখালীর দূরত্বের সমান। আমরা যেখানে কমবেশি ছয় থেকে আটঘণ্টা ড্রাইভ করে যাতায়াত করি। অনেকটা পাহাড়ি সড়ক হওয়ার পরও এখানে দেখাচ্ছে, সোয়া দু’ঘণ্টা। কবি এখানেই নিরব। ঘণ্টা দুয়েক পর্বত আরোহণ শেষ করেও এ ড্রাই্ভে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরা যাবে অনায়াসে। বহু দেশের মানুষ বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন কূটনীতির কট্টর সমালোচনা করে। কিন্তু স্বপ্নের দেশ হিসাবে বিশ্বজুড়ে এর খ্যাতি এখনও কম না। সব দেশ থেকেই  স্বপ্নবাজ তরুণের গন্তব্য আমেরিকা।

গাড়ি ছুটছে একশ চল্লিশ কিলোমিটার গতিতে। ঘরের বাইরে যাচ্ছি, অথচ শুনতে মন চাইছে ঘরে ফেরার গান। এ সময় মার্কিন শিল্পী স্কাইলার গ্রের ‘টেল দ্য ওয়ার্ল্ড, আই এম কামিং হোম’ গানটি প্লেয়ারে চালানো হলে মন্দ হতো না। অন্তত আইস শিল্পী আসগের এসনাইরসনের ‘গোয়িং হোম। এমনই মন আমার, বিপরীতমুখী উপাদানে গড়া। নিজ সম্পর্কিত নিজস্ব ট্যাগলাইন: ‘বোহেমিয়ান ও ঘরকুনো, কোলাহলপ্রিয়  ও অন্তরালপরায়ণ। মন চাইলে কি হবে কে যেন চালিয়ে দিয়েছে সাহানা বাজপেয়ীর রবীন্দ্রসঙ্গীত- ‘ আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, প্রাণ সখা বন্ধু হে আমার’, আকাশ কাঁদে হতাশ সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম, দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার’।

গতিময় গাড়ির বিপরীতে ধীরলয়ের এই গানও মনে  বিপরীতধর্মী আনন্দ জোগাচ্ছে।

রবিঠাকুরের গানের কথা ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে গাড়ির ভেতর চলছে সফলতা, ব্যর্থতাসহ জীবনের স্বপ্নজাগানিয়া সব প্রণোদনার আলোচনা। বলি, আমি সব বিষয় অনুপুঙ্খ বলতে পছন্দ করি। শ্রোতাকে প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অজানা ভেবে প্রেক্ষিতসহ সব বলতে গিয়ে কালক্ষয় হয়। ডেল কার্নেগীর একটা জনপ্রিয় জীবনভাবনা হচ্ছে বক্তার ধৈর্যশীল শ্রোতা হতে পারা সাফল্যের বড় উপাদান। আজকালকার মানুষ সোস্যালমিডিয়াতাড়িত। শ্রোতা হিসাবে তার সময় কম, তারা  সবকিছু নাটশেলে শুনতে চায়। অধৈর্য হয়ে বক্তব্যের মধ্যেই দুম করে উপসংহার জানতে চায়। আমি বলেই চলি, ছোট জিনিসকে কল্পনার বিস্তারে বড় করতে পারা এক আর্ট, অন্তত সাহিত্যে।  এই ডিটেইলাররা জীবনে খুব অসফল তাও বলা যাবে না। অর্থের মাপকাঠিতে সাফল্য বিচার এদের কাছে গৌণ।

স্টেয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরে পলের মনোনিবেশ গাড়ি চালানোয়। গাড়িভর্তি সকলের নিরাপত্তা আপাত: তার জিম্মা ও নীবিষ্ঠতায়।  তবু ভেতরের আলোচনা সে মন দিয়ে শোনে,  অনুপুঙ্খ বলাটাকে আর্ট বলে স্বীকার করে নেয়। তবে তার বক্তব্য , নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে ক্রমশ: বিষয় সংক্ষিপ্ত হয়, সেটাই কাজের। নিচের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বয়ান শীর্ষকর্তার কাছে এক লাইন বা নাটশেলে পেশ হয়। চাকরির ক্ষেত্রে যে যতো নাটশেলে বলতে পারে, সে ততো দক্ষ ও সফল। গাড়ির ভেতরের অন্য সবাই তার কথারই সমর্থন করে। আমার অনুপুঙ্খ বলার যুক্তি খুব একটা সমর্থন পায় না। সবাই প্রায় বয়সে আমার চেয়ে বয়ো:কনিষ্ঠ। এরা  প্রযুক্তিযুগের মানুষ। জেনারেশন গ্যাপে এদের চিন্তাচেতনা স্বভাবীরকমে আলাদা। অনুপুঙ্খ কথন ভঙ্গিটি  ষাট সত্তর দশকের গল্পবাজ মানসকিতা থেকে এসে থাকতে পারে ভেবে আমি প্রসঙ্গান্তরে যাই।

রেন্টনের লিবার্টি পার্ককে ডানে রেখে আমরা ফ্রি ওয়ে থেকে নেমে যাই ১৬৯ নম্বর সড়কে। এই সড়ক ধরে শর্টকার্টে ক্রিস্টাল মাউন্টেনে যাওয়া যাবে বলে জিপিএস দেখাচ্ছে। তাকোমা বন্দর থেকে আরেক সড়ক ধরে গেলে পর্বতপ্রান্তে এলবি শহর পাওয়া যায়। এখান থেকে মিনারেল শহর পর্যন্ত ভিন্টেজ রেল। রেলগাড়ি চড়েই  মাউন্টরেইনিয়ার দূর থেকে দেখা যায়। আমাদের আগ্রহ ক্রিস্টাল মাউন্টেনের চূড়ায় রেইনারের কোমর সমান্তরালে বসে রেইনিয়ারসুন্দরীকে দর্শন।

দুই.

গাড়ি দৌড়াচ্ছে। ক্রমশ নীবিড় বন ও পর্বতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারছি । ম্যাপল গল্পকোর্সকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগুলে ম্যাপল ভ্যালি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পরিচিত বৃক্ষ ম্যাপল এর নামে গড়ে উঠা উপত্যাকাটি দিগন্তজোড়া। রাস্তা ফুরিয়ে এলেও ম্যাপল নামের উপত্যাকাটি শেষ হতে চায় না। এই রাস্তায় যেতে থাকলে চোখে পড়ে ছোট পর্বত পাদদেশর শান্ত নিরিবিলি ছোট ছোট শহর। ক্রমশ বনের নীবিড়তা বাড়ে, লোকালয় কমতে থাকে। ম্যাপল উপত্যকার পর ব্লাক ডায়মন্ড নামে একটি ছোট শহর পাই। এরপর ঘনবনের ভেতরে প্রবেশের আগে শেষ শহর বলতে গেলে এনামক্ল। এ শহরে দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও পেট্রাল পাম্প দেখি। শহরের অদূরে ১৬৯ সড়ক মিলিত হয়েছে ৪১০ নম্বরে। দৃষ্টিগ্রাহ্য সেতু না থাকলেও  একটি ছোট নদী পেরিয়ে যাই। শহর ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই নদীটি আমাদের সঙ্গী হয়। নাম তার শ্বেত নদী, হোয়াইট রিভার।

শহুরে কোলাহলের পর বনানীময় নির্জন নীরবতা আর ছুটে চলার দুলুনিতে গাড়ির ভেতরেও স্তব্ধতা নেমে আসে। আমি ছাড়া সবাই ঝিমুনিভাবে চুপচাপ। আকস্মিক তুসুর ‘ওয়াও’বলে চীৎকারে অন্যরা আড়মোড়া ভেঙে বসে। ক্যামেরা বাগিয়ে ভিডিও করতে শুরু করেছে সে। গাড়ি সামনে সোজাসুজি  স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাউন্ট রেইনিয়ার-  পশ্চিমপ্রশান্তে ওয়াশিংটন স্টেট পাহাড়পুঞ্জের সম্রাজ্ঞী। আকাশমুখো নীরবে মাথা তুলে দাঁড়ানো পর্বত অনায়াসে নজরে আসায় সবাই খুশি। পর্বতকে চোখের সামনে রেখে গাড়ি ছুটতে থাকে। আঁকাবাঁকা রাস্তার জন্য মাঝে মাঝে দৃষ্টিসীমার ডানে বাঁয়ে চলে যায় রেইনারসুন্দরী, কখনো লুকোচুরি খেলে দীর্ঘ পাইনগাছের পেছনে, পরক্ষণেই উদ্ভাসিত হয় উচ্চতার স্বমহিমায়।

পল বলে, ‘উই আর গোয়িং টু সী হার ফ্রম হার আর্মস। বাট আই এ্যাম এ্যাফ্রেইডম গন্ডোলা অব ক্রিস্টাল মাউন্টেন ইজ ক্লোজ অর ওপেন।‘

বলি, ভ্রামণিকগণ মনে করেন গন্তব্য পৌঁছাই শুধু ভ্রমণ নয়। এই যে ড্রাইভ করে যাচ্ছি ঘনবনের নীবিড় নির্জনতাকে উপভোগ করতে করতে, সামনে আপাদমস্তক মাউন্ট রেইনিয়ার, এটাই তো সফল এক ভ্রমণ। ভ্রমণের প্রতিটি মূহুর্ত বৃথা নয়।

এখনও চোখের সামনে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। পাহাড়ের পাদদেশের তৃণলগ্ন বিস্তীর্ণ ক্ষেতে গরু বা ভেড়া চড়ছে। বহুদূর পেরিয়ে যাওয়ার পর দুয়েকটি ফার্ম হাউজ। 

আজকের ক্যাপ্টেন পল বললো-‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নীবিড় বনানীতে ঢুকে যাবো। সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান। সেখানে বনপাহাড়ি কটেজ, কেবিন আর ক্যাম্পগ্রাউন্ড ছাড়া  কোন লোকালয় নেই।‘

বলতে না বলতে গাড়ি এক নীবিড় জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যায়। আশ্চর্য গাড়ির ভার্চুয়াল প্লেয়ার তার প্লেলিস্ট থেকে বাজিয়ে দিয়েছে মেঘদল ব্যান্ডের গান-

‘চেনা অচেনা আলো আধারে/ চলতি পথে কোন বাসের ভিড়ে/কালো ধোঁয়া ধোঁয়ার এই শহরে/ চলছি আমি একা রোদ্দুরে/ আমি এক দিকভ্রান্ত পথিক/হারাই্ শুধু হারাই তোমার অরণ্যে’…।

‘হারাই শুধু হারাই তোমার অরণ্যে, হারাই শুধু হারাই তোমার অরণ্যে’  রিদমের মধ্যে গাড়ি হারিয়ে  যাচ্ছে পাহাড়ি অরণ্যে, বনের নির্জন পথ ধরে শহর থেকে দূরে। পরের গান-

‘ভীষণ গন্ধ ডুমুর ফুলে,মাকালের লাল মেখে/ শুকনো নদী বুকে,রাতের রোদ্দুরে’।

আশ্চর্য টেলিপ্যাথি, আশপাশে বুনোফুলের গন্ধ। আমাদের চলার সঙ্গী হোয়াইট রিভার বরফগলা নদী বলে এই শরতে শুকিয়ে কাঠ । বুকে জেগে আছে কেবল পাহাড়ি নুড়ি ও ছোট পাথর।

প্লেয়ারে বাজতেই থাকে- ‘শহরবন্দী মেঘ, ঘুরে ঘুরে একা/ আমাদের এই সুবর্ন নগরে/ আমিও পেতেছি কান, শুনি বৃক্ষের ক্রন্দন/ ধূসর রাজপথের প্রান্তরে’….।

বৃক্ষবৃন্দের মধ্য দিয়ে ছুটছি  নি:সঙ্গ মৃসণ সড়কে। কর্ণকুহরে ‘মেঘদল’ এর এই শহর, মেঘ, বৃক্ষের গান।

দু’ধারে পাইনবনের সারি, ট্রেকারদের কেবিন, আরভি স্টেশন, ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড,,পাহাড়ি বাঁক। বন ঘন হয়ে আসে কোথাও, কোথাও আবার ফাঁকা ফাঁকা। পাহাড়ের পাদদেশে কোথাও সবুজক্ষেত ও বুনোফুল উপত্যকা।  পাহাড়ি সড়কটি এতোটাই বনানীময়, একটি সরলরেখায় আকাশটিই শুধু দেখা যায়। কোথাও কোথাও ভিউপয়েন্ট। নদী ও ঝর্ণা দেখার আড়ম্বর। গ্রিনওয়াটার পেরিয়ে আমরা আরও ঘনবনে  ঢুকে যাই। রেইনারকে কেন্দ্র করে অজস্র পাহাড় নিয়ে গঠিত এই্ ক্যাসেকেড অরণ্যে অজস্র বৃক্ষ। শুনেছি পাইন ও স্প্রূস  ফ্যামিলির বৃক্ষই আছে ১৩ প্রজাতির। এগুলো চিরসবুজ, কখনো পাতা ঝরে না।  মাপল, ডগউড, বার্চ, রোজ ও উইলো ফ্যামিলির বৃক্ষের প্রজাতিও সমসংখ্যক। এগুলো ঋতুভেদে রঙ বদলায়, পাতা ফেলে আবার  নতুন পাতা ধারণ করে।

মাউন্ট রেইনিয়ার ন্যাশনাল পার্কের দিকে না গিয়ে বামে ক্রিস্টাল মাউন্টেন বুলুভার্ডের শেষপ্রান্তে ক্রিস্টাল মাউন্টেন রিসোর্টে গিয়ে গাড়ি পার্ক করি। পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে রিসোর্ট ও বিনোদনকেন্দ্র। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে টিকেট টঘর, গন্ডোলা স্টেশন, স্যুভেনির শপ, রেস্তোরাঁ, বাথরুম। বরফের মৌসুমে তা দিবারাত্রি ভরে থাকে স্কিইআর তুষার স্পোর্টসম্যানদের ভিড়ে। এখন শরৎ।  পার্কিং লটগুলো ঝিমু্চ্ছে অলস অপরাহ্নে। আমাদের মতো মৌসুমী পর্যটকদের আনাগোনার অবশ্য বিরাম নেই।

কয়েকটি ছোট পাহাড় ও পাহাড়ি উপত্যকা পেরিয়ে ক্রিস্টাল মাউন্টেনের চূড়ায় উঠতে গন্ডোলায় চড়ি।  লাল ও সবুজ রঙের ৩০টি গন্ডোলা ঘূর্ণায়মান।  ২৮ নম্বরটিতে  চেপে মিনিট দশেকে সাতহাজার ফুট উঁচুতে উঠে যাই। গন্ডোলাগামী পর্যটক ও পাহাড়পুঞ্জের দূর্গম ট্রেইলে হাইকিংশেষে সামিটজয়ী পর্বতপ্রীতদের খাবার পাণীয় সেবায় উন্মুখ সামিট হাউজ রেস্তোরাঁ। এই সামিটে উঠেছি ওয়াশিংটন স্টেটের প্রকৃতিসম্ভারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুকুট মাউন্ট রেইনিয়ারের অপরূপ শোভার আকর্ষণে। জীবন্ত আগ্নেয়িগিরিময় মাউন্ট রেইনার রেঞ্জে স্কিইং,হাইকিং, ফিশিং, স্নোবোর্ডিং, হর্স রাইডিং, ক্যাম্পিংয়ের মতো নানা ট্যুরিস্ট এ্যাক্টিভিটি করা যায়।  ১৪ হাজার ৪১১ ফুট উচ্চতার পর্বতটির কোমর সমান্তরাল থেকে পুরোটা দৃষ্টিগোচরে আনতে হলে স্ফটিক পর্বতে ওঠা ছাড়া উপায় নেই। ক্রিস্টাল পর্বতের চূড়ায় উঠে কেউ রেস্তোরাঁ চত্ত্বরের টেবিলে বসে পাহাড়টি উপভোগ করে, কেউ সামনের ইজিচেয়ার বা বেঞ্চে অদূরের মাউন্ট রেইনিয়ারের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, কেউ আরেকটু নিচে নেমে হাইকিং করে। গন্ডোলার ল্যান্ডিং স্টেশনের দু’দিকে চেয়ারলিফটও আছে। তা খোলা হয় অন্য মৌসুমে।

আমরা ক্রিস্টাল মাউন্টেনের চুড়া থেকে নিচে একবার স্নোর্টিং এল্ক বোওল এর দিকে, আরেকবার  পাউডার পাসের দিকে সামান্য হাইকিং করি। আবার সামিট হাউসের সম্মুখে গন্ডোলা লোডিং স্টেশনে ফিরে এসে উঠে পড়ি গন্ডোলায়।

আকস্মিক আবার দেখা হয় সেই শ্রশ্মগুম্ফমন্ডিত রেস্তোরাকর্মীর। সে তখন আবর্জনার ব্যাগ ফিতেয় বেঁধে একাই এক গন্ডোলায় চেপে নিম্নগামী হচ্ছে। আমার মনে হয়, জীবনের কোন লগ্নে পাহাড়প্রেমে মত্ত মানুষটি চাকরির ছুতোয় এসে উঠেছে এই সাতহাজার ফুট্ উচ্চতায়। প্রতিদিন নিয়ম করে গন্ডোলায় চেপে ক্রিস্টাল সামিটে চড়ে আর কোমর সোজা বসে উপভোগ করে রেইনারসুন্দরীর। এ জগতে বসেও সে ভিন্নজগতের বাসিন্দা। #

মাহমুদ হাফিজ
মাহমুদ হাফিজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *