কালিম্পঙ কাল

লাভা মনস্ট্রির ভিক্ষুদের সঙ্গে লেখক

কালিম্পঙ বাসস্ট্যান্ডে যখন পৌঁছি, ছোট্ট পাহাড়ি শহরে তখন সবে সন্ধ্যা। সুদর্শন তরুণ সুমো চালক রিনি গুরুং গাড়ির ছাদে রশিতে বাঁধা লটবহরের শক্ত গিঁট খোলায় মগ্ন। একেকটি লাগেজের বাঁধন আলগা করছে আর নিচে অন্য ড্রাইভারের বাড়ানো হাতের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। রিনি গুরুংকে সাফ জানিয়ে দিয়েছি- আমি লাগেজ ধরতে পারবো না, আমার ‘ফ্রোজেন শোল্ডার’।

নেপালি বংশোদ্ভূত গুরুং জাতিগোষ্ঠির অল্পবয়সী চালক রিনি ‘ফ্রোজেন শোল্ডার’ বা এর ব্যথার হদিস না জানলেও বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বুঝেছে- নিক্ষিপ্ত ভারি লাগেজ ধরে মাটিতে নামানো আমার কম্মো নয়। কাজেই বাস্টটপের পরিচিত ড্রাইভার ডেকে হেল্প নিচ্ছে। কোমরে গামছা পেঁচিয়ে ছাদে হামা মেরে একটা করে লাগজে নামাচ্ছে আর একবার করে আমার দিকে পিট পিট করে তাকাচ্ছে।  ভাড়া চুকিয়ে দেয়ার তাগাদা দিচ্ছে, যাতে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় শহর থেকে নিস্ক্রান্ত হতে পারে। পনেরো কিলোমিটার পাহাড় উজিয়ে আলগারায় নিজের ঘরে ফিরতে হবে তাকে।দু’দশ রুপি বাড়িয়ে দেয়া আর তার মাধ্যমে হোটেল নেয়ার কথা বলে আমি কালক্ষেপণ করতে চাচ্ছি। কারণ পাঁচ কন্যা জায়া জননীসহ সাতজনের যে ভ্রমণদলকে নিয়ে ভরসন্ধ্যায় কালিম্পঙে নেমেছি, তাদের কাউকে ধারে কাছে দেখছি না। গাড়ি থামতেই তারা জোড় বেঁধে উধাও। পর্যটকভরা এ শহরে রাতে থাকার ব্যবস্থা করা ঝক্কি বলে আমার সিক্সথ সেন্স জানান দিচ্ছে। কাজেই গুরুংকে গুডবাই এর বদলে গাইড বানিয়ে এ রাতে আন জানপহচান কালিম্পঙে হোটেল নিশ্চিত করে নেয়া মন্দ না !

পর্যটকপ্রিয় পাহাড়ি শহর রাত জাগে না। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সর্পিল রাস্তায় রাত বিরাতে গাড়ি চলে না বলাই ভালো। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় এখানকার হোটেল-হোমস্টে, বোর্ডিংগুলো বুক হয়ে যায়। আগাম বন্দোবস্ত না করে দূর্গম গ্রাম খোলাখাম থেকে হুট করে এসে পড়ায় থাকা নিয়ে মাথায় বেজায় টেনশন নিতে হচ্ছে। এরওপর ভ্রমণদলের পাঁচজনই কন্যা-জায়া-জননী। বোহেমিয়ান হিসাবে আমাদের ‘যাহা রাত তাহা কাৎ’কেতায় বাসস্টপের বেঞ্চে রাত গুজরান চলে। মা-মেয়েদের জিরিয়ে-গড়িয়ে নেয়ার জরুরতে আরামপ্রদ সরাইয়ের বিকল্প নেই। গাড়ি থামার পর সহযাত্রীগণের উধাও হয়ে যাওয়া এই উদ্বেগে বাড়তি চাপ। থ্যাংক গড, রিনি গুরুং আসার পথে দেখিয়ে নিয়ে এসেছে জনপদের লোভাতুর দ্রষ্টব্য-লাভা ও রিশপ। উপনিবেশায়িত শহর কালিম্পঙয়ের বাঙালির সবচেয়ে আকর্ষণ কী? অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। মৈত্রয়ী দেবীর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে বিশ্বকবির জীবনপ্রান্তের যেসব অন্দরকাহিনী আর দিনানুদিনের খুনসুটিকথা মাথার চিপে ভরে আছে,সেই স্মৃতিময় জায়গাগুলো তো ওই কালিম্পঙেই! রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত ‘গৌরিপুর কটেজ’সহ এখানে দেখবো উপনেবিশ আমলের মরগ্যান হাউজ, বৌদ্ধ টেম্পলখ্যাত ভিউপয়েন্ট ডেলোপার্ক ইত্যাদি। উদ্বেগময় বিহঙ্গমনে সেগুলোই প্রশান্তিদায়িনী !

সাত পর্যটকের চৌদ্দটি;র শেষ লাগেজটি নিক্ষেপ করে লাফ দিয়ে নিচে নামে রিনি। আসার পথে গাড়িতে সে সস্তার হোটেলের সুবন্দোবস্তের তথ্য দিয়েছিল আমাদের। আমি রিনি গুরুংকে বলি, ‘চলো তোমার পরিচিত হোটেলে সস্তায় থাকার বন্দোবস্ত দেখে আসি।‘কী ইন্ডিয়া কী ইন্ডিয়ানা, সর্বত্র ভ্রমণের একই রেওয়াজ। নগর গ্রামের হোটেল-হোমস্টে সবই পর্যটকবাহী ড্রাইভারদের চিরচেনা।

মাল সামান পরিচিত ড্রাইভারের জিম্মায় রেখে রিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে পাশের আধো অন্ধকার গলিতে উধাও হয়ে যায়। বাসস্টপ ছাড়া এখানকার গলিগুলোতে আলো আঁধারির খেলা। মানুষের নিত্য দরকারী ও যানমুখী দোকান-কাউন্টার বাদে অন্য পসারের ঝাঁপ একের পর এক নামছে। সন্ধ্যার পরই লোকজন ঘরে ফেরার তাড়ায়। আমাদের চালক বয়সে তরুণ হলেও এলেমদার। সুমোয় দেশ বিদেশের ভ্রমণিয়াদের বহন করতে করতে মানুষের মাইন্ড রিড করতে শিখে গেছে। গলিপথে চলতে চলতে নিরবতা ভাঙে সে। শুদ্ধ বাংলায় বলে, ‘পাহাড়ি দেহাত-শহরগুলো এমনই স্যার। সন্ধ্যার পরই নির্জন। আলো নিভে যেতে বেশি রাত লাগে না।‘

আমি ঘুরে বেড়ানো মানুষ। গুরুংয়ের কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। তার পিছু এগিয়ে যাই।

শহরের মেলা গ্রাউন্ড ও ত্রিকোণ পার্কের দেয়াল ঘেঁষা রাস্তা ঘুরিয়ে সে ডক্টর অংডেন রোডে পুরনো এক তেতলা ভবনের রিসেপশনে এনে আমাকে দাঁড় করায়। করিডোরে ঢোকার মুখে দেখতে পাই ‘থাকার সুবন্দোবস্ত’ সাইনবোর্ড। ভেতরে পা দিয়ে বুঝতে পারি মধ্যবয়স পেরুনো মালিক নিজেই সাতপুরুষের ব্যবসা সামলাচ্ছেন। ভদ্রলোকের মাথার কেশদাম উধাও, তেল চকচকে টাকে আলোর বিচ্ছুরণ। মেদবহুল পেট জানান দিচ্ছে ভোজনপ্রিয় লোকটি হোটেল নামের গদিঘরে বসে ষাটোর্ধ জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। ত্রিকোণ পার্ক বা মেলামাঠের খোলা হাওয়ায় দু’দন্ড হাঁটার নাম করেননি। খনা আমলের কবিরাজী টোটকা বা প্রযুক্তি যুগের ইয়োগা, ওয়ার্কআউট ও ন্যাচারাল মেডিসিনের অনলাইন কারবারিদের স্বাস্থ্য বটিকা এখনও এঁর নাগালের বাইরে। যাহোক, এ মুহূর্তে আমার কাজ হোটেল মালিকের চরিত্রচিত্রণ নয়, থাকার সুরাহা করা।

অবোধগম্য ভাষায় তার সঙ্গে রিনির কথাবার্তায় বুঝি এই লোক এ অঞ্চলে নেপাল থাকে আসা গুরুঙ জাতিগোষ্ঠির, আর রিনি গুরুংয়ের জাতভাই। বাইরের বোর্ড চটকদার রঙে ‘থাকার সুবন্দোবস্ত আছে’ বাক্যবন্দের বন্দোবস্তের নমুনা ভিতরে ঢুকেই আঁচ করা যায়। তবু সস্তার তিন অবস্থাটা যাচাই করতে আমি কক্ষ দেখতে আগ্রহী হই।

‘তিনতলায় দুটো রুম খালি আছে’ বলে চাবির গোছায় সঠিক চাবিটি খুঁজতে খুঁজতে সিঁড়িতে উড্ডীন হন ওজনদার ভুঁড়েল। তাকে অনুসরণের ইঙ্গিত দেন। দেখি, কক্ষগুলো বড়ই। সাধারণ মানের খাট, চৌকি ও বিছানাসজ্জিত। হাইকমোডহীন বাথরুমে প্লাস্টিকের ট্যাপের সামনে আধভরা বালতি। পানির দাগের ধকলে ট্যাপ ও বালতির আসল রঙ উধাও হয়েছে বহুকাল। কয় মাস পর পর বালিশ-বিছানার কভার বদল হয় সে হদিশ টেকো মালিকও বলতে পারবে বলে মনে হয় না। ভুঁড়েল মালিক ভরসন্ধ্যায় সাতজনের দলে পেয়ে গদগদ কন্ঠে বলেন, ‘এ্খানে জলের সমস্যা পাবেন না দাদা। বালতির জলে রাতটা চালিয়ে নিতে হবে। সকালে ‘চানের’ আগে আমাদের ছেলেরা নতুন জলে বালতি ভরে দেবে’।

‘এতো জলে পড়িনি’-ঝট করে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অস্ফূটধ্বণি। ভুঁড়েল জিজ্ঞেস করেন,’ কিছু বললেন?’

উত্তর না দিয়ে ‘চলুন নিচে যাই’ বলে আমি আগে আগে নামতে থাকি। ঘর দুটোয় চাবি মেরে ভুঁড়েল মালিক নাগাল পাওয়ার আগেই নিচে বসা রিনি গুরুংকে বলি, ‘চলো স্ট্যান্ডে যাই।‘

ফিরে দেখি আমার ছয় সহযাত্রী প্রকট হয়েছেন। যে দ্রুততা ও আকস্মিকতায় তারা উধাও হয়েছিলেন, সমান বেগেই আবার মওজুদ। কেউ দায়িত্ব না দিলেও ভ্রমণকালে মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া চালাতে চালাতে নানা জায়গা থেকে একহওয়া ভ্রমণদলের অলিখিত টিম লীডার হয়ে উঠেছি । সহযাত্রীগণও কম যান না। যেন যুদ্ধ ময়দানে পরাজিত হয়ে ফেরার পর সেনাপতিকে কৈফিয়ত দিচ্ছেন- এমন কেতায় ‘ওজরখাহী’ পেশ করতে শুরু করেছেন। জানা যাচ্ছে, ভ্রামণিক কামরুল হাসান পাশের গলিতে ডলার ভাঙানোর ব্যর্থ কসরত করেছেন, পরে বেরিয়েছিলেন হোটেল ঢুঁড়তে। ভাবি,  সাতসকালে মাথায় আসা নতুন কবিতার লাইন আওড়াতে আওড়াতে জেগে ওঠা মানুষ এই ভ্রামণিক, তার বিশ্রামের সময় অতিক্রান্ত হচ্ছ। ডুয়ার্সের বিনীতা সরকার বাংলাদেশের নাহিদ সুলতানাকে নিয়ে পরিচিত স্হানীয় একজনকে নিয়ে গলির সোনার দোকান থেকে ডলার বিনিময় করে ফেলেছে। ভ্রামণিক বিনীতা পেশায় শিক্ষক, কথা বলে লোকজনকে কনভিন্সড করতে পারা তার করায়ত্ত। ভ্রমণে কমঅভিজ্ঞ নাহিদ সুলতানা বিনীতার সঙ্গে অলিখিত জোট করে ডলার সমস্যা সমাধান করেছে। শিলচরের মিতা পুরকায়স্থ কলেজপড়ুয়া কন্যা বিশ্বরূপাসহ আমার গৃহবন্ধু জলি ফেরদৌসীকে নিয়ে ছুটেছিল বাসস্ট্যান্ডের প্রসাধনকক্ষে। লম্বা লাইন থাকায় সময় লেগেছে।

সবার উধাও হওয়ার সমস্বর কৈফিয়তে  মন্তব্য না করে বলি, ‘এখন হোটেল ঠিক করাই আমাদের মূল কাজ। রিনি গুরুঙয়ের ‘বন্দোবস্ত’ ফেল মেরেছে। আমার মনে হয়,  ন্যাওড়াভ্যালির দূর্গম গ্রাম কোলাখাম থেকে লাভা, রিশপ,আলগারাহ হয়ে কালিম্পঙ আসতে পাহাড়িপথের ঝাঁকুনিতে এখন সবাই পর্যাপ্ত ক্লান্ত। ক্ষুৎপিপাসায়ও কাতর। আগে চাই থাকার যোগাড়জন্ত’।

আকাশআকাঙ্খী নতুন পুরনো ভবনগুলোর মাঝে এক চিলতে সমতল মাঠে গড়ে উঠেছে বাস-ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। গাড়ির থামার পর গন্তব্যজানা  পর্যটক ও ঘরফেরতা স্থানীয়রা নিরুদ্বেগে নিস্ক্রান্ত হচ্ছেন। হোটেল না পাওয়া পর্যন্ত আমরা স্ট্যান্ডেরই মুসাফির। সামনে আলো ছড়াচ্ছে আকাশমুখী ভবনগুলোর নিয়ন সাইন। পোখরেল, জানকী, ক্ল্যাসিক, পঞ্চবটি হোটেল সাইনগুলো উজ্জ্বলতর। তিন জনকে লাগেজ পাহারায় রেখে বাঁকিরা চার হোটেলের নিয়ন সাইনের নিশানা ধরে ছুটি চারদিকে। আমার ভাগে পড়ে হোটেল জানকী। বিধি বাম। ‘বাংলাদেশ’ শুনেই জানকী জানিয়ে দিয়ে ভিনদেশি অতিথিতে তাদের অরুচি। ভ্রমণদলে তাদের স্বদেশী ভাই ভগিনীগণ আছে জেনেও গলে না জমাটবাঁধা জানকীর জান।  

আমাদের কালিম্পঙকাল এই রাতটির জন্যই। সিকিম-দার্জিলিঙ যাওয়ার পথে কালিম্পঙে ‘স্টপবাই’ করে যাচ্ছি। ভ্রমণ ঠিকুজিতে কালিম্পঙের জন্য বরাদ্দ দুই দিন এক রাত। দিনমান ধরে আসার বেলায় জেলার কিছূ দেখনকেন্দ্র দেখা শেষ। রাতশেষে আগামী দিনটি পুরোটা হাতে।  পড়ন্ত অপরাহ্নে পরের গন্তব্য সিকিমের গ্যাংটক রওয়ানা দিলেই চলে। রাত গুজরানে সাতজনের জন্য কম করে চারটি কক্ষ চাই। দূর্ভাগ্য, বাকি তিনজনও ফিরে হোটেল না পাওয়ার খবর দেয়। প্রতীতি জন্মে, শহরের এই শীতরাত আমাদের উষ্ণতায় স্বাগত জানাচ্ছে না। একই হোটেলে চারটি কক্ষ মেলানো দূরাশা। প্রত্যাশার বক্সগুলোয় একটিপর পর একটি টিকের বদলে ক্রস চিহ্ন পড়তে থাকে। ‘পাওয়া মাত্রই বুক’ এই থামরুলে  হোটেলের খোঁজে আবার বেরিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ বাদে ভ্রামণিক কামরুল হাসান প্রথম সুসংবাদটি আনেন। সিঙ্গেল রুম বুক করে তিনি আনন্দ নিয়ে ফেরেন। হোটেলের নাম ‘পঞ্চবটি’। খবর জানিয়ে তিনি লাগেজস্তূপ থেকে তাঁর চাকা লাগানো মেজেন্টা রঙের ব্যাগটি টেনে ঘড়র ঘড়র শব্দ তুলে মুহূর্তেই গলির মধ্যে উধাও হয়ে যান। ঘর্ষণমুখরতা আমার কানে বাজে ভিন্নরূপে। মনে হয়, তিনি এ রাতে ঘোড়া দাবড়ে পঞ্চবটি বনের দিকে ছুটে চলেছেন ! দ্বিতীয় সুখবর আনে নাহিদ আর বিনীতা। তারাও একটি কক্ষ পেয়ে বুক করে ফেলেছে। এবার চাকাওয়ালা লাগেজের ঘড়র ঘড়র শব্দ দ্বিগুণ হয়ে কানে বাজে। হোটেলজয়ীরা দিগ্বিজয়ীর বেশে সমুখপানে চেয়ে ধাবিত হন, পিছনে তাকানোর ফুরসৎ পান না বলেই বলা চলে।

রইলো বাঁকি চার। আর দুটি কক্ষ হলেই আমাদের চলে। মুসকিল আসান হিসাবে উদিত হয় মিতা। লেখক ও ব্যবসায়ী মিতা স্বামীর অবর্তমানে ব্যবসা সামলাতে গিয়ে দুনিয়ারি রপ্ত করেছে পুরোদস্তুর। জীবনযাপনের প্রয়োজনে নিখিল বঙ্গ ভারতে প্রায় সবধরনের সেবাদাতার সঙ্গে নীবিড় নেটওয়ার্ক শিলচরনিবাসী নীরালম্বী মিতার। এই অসমী মা মেয়ের সঙ্গে কয়েকদিন আমরা মিয়া বিবি ভ্রমণ করে বুঝেছি, থাকা, যাতায়াত, খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত বা মুশকিল আসানে মিতা সর্বদা যোগাযোগপ্রিয়। তার কমিউনিকেশনজাল থেকে দূরালাপনে হলেও পরামর্শ নিতে বা ভ্রমণকালে স্টাফদের দূরনির্দেশ দিতে ফোনালাপে শশব্যস্ত সে। মিতাই খবর দেয় থাকার বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। কালিম্পঙে হোটেল বুক করতে মিতা হয়তো ফোনে ধরেছে বাংলাদেশ বা বাঙ্গালুরুর কোন পরিচিতজনকে। যাহোক, রাত গভীরতার দিকে না গড়াতেই আমাদের লাগেজের চাকাগুলো সক্রিয় হয়। হোটেল পোখরেলের দিকে যেতে ঘড়র ঘড়র শব্দ তোলে।

পোখরেলে দুটি কক্ষ খালি। ম্যানেজারের শর্ত: ‘ জলের সঙ্কট, সকালের আগে বাথরুমে জল আসবে না‘ আমরা তাতেই সই। বিজলারি পানির বোতল কিনে চালিয়ে নেয়া যাবে ভেবে জলহীন হোটেলকক্ষ চড়া দামে ভাড়া নিতে কালবিলম্ব করি না। হোটেল বিছড়িয়ে ভাল লেসন হয়েছে। জীবন কখনো কখনো এমন হালতে ছেড়ে দেয়, যখন অপশনের আলোগুলো একে একে নিভতে থাকে। নিজের অটল অবস্থান নড়ে যায়, কম্প্রোমাইজ শত হাত মেলে স্বাগত জানায়। আজ সন্ধ্যারাতের হোটেল সন্ধান থেকে এ শিক্ষাও নেয়া গেল যে, নিজের খতরনাক হালত মানুষের সৌজন্যবোধেও আলবত আছর করে। আত্মমগ্নতায় আমাদের লাগেজের চাকাগুলো তখন ঘড়র ঘড়র শব্দ তুলে সামনে আগুয়ান হয়,পিছনে ফেরে না।

বোতলের পানিতে ফ্রেশ হয়ে পূর্বকথামতো রাত সাড়ে নয়টার পর কালিম্পঙ কিচেনে হাজির হই। উদ্দেশ্য, একসঙ্গে নৈশাহার আর দুপুরে কোলাখাম থেকে রওয়ানা হওয়ার পর যা যা ঘটলো তার জাবর। কালিম্পঙ কিচেন কেন? রেস্তোরাঁটি হাঁটা দূরত্বে আর আমাদের থাকার হোটেলগুলোর কেন্দ্রে। সবার জন্যই সমান পথ। স্ট্যান্ডের আশপাশে ‘পঞ্চবটি’র মতো মিথমথিত নামে ভাত মাছ ডাল তরকার স্থানীয় রেস্তোরা আকছার।‘কালিম্পঙ কিচেন’ নিশিজাগরণেচ্ছু। পর্যটকদের প্রয়োজনের নিরিখে বহু রাত অব্দি খোলা। পরিবেশ,পরিবেশন ও ওয়েটারদের বেশভূষা কলোনিয়াল হ্যাঙওভারগন্ধী হলেও খাবারের মেন্যু ফিউশনীয়। কাজেই দিনমানের ক্লান্তি ও নানা ভোগান্তি সামলানো পরিব্রাজকদের কেউ যদি ইংরেজকেতার পরাটার সঙ্গে ডাল মাখনি, চিকেন বারবিকিউ আর শেষপাতে সনাতনী ম্যাংগো চাটনি মেলে ধরে,তখন আর কার না ভালো লাগে!

পছন্দ মতো খাবার অর্ডার করে গদিওলা চেয়ারে আরাম করে বসি। খাবার আসার ফাঁকে দিনের ভ্রমণ আলাপ জমানো যায়। মজমা জমানোর মন নিয়ে সবাই পা টা মেলে, নড়েচড়ে বসে। আমার মনে হচ্ছে, এসে পড়েছি মিথাশ্রিত সাম্রাজ্য কলোনাইজারদের গড়া পাহাড়ঘেরা স্বপ্নরাজ্যে। আমাদের গায়ে এসে লাগছে কলোনিয়াল হ্যাঙ্গওভারগন্ধী বাতাস- ‘উপনিবেশিক ঝুলনমায়া’র মায়াবী গন্ধ।  

হোটেল পাওয়ার আনন্দে আকস্মিক মিতা পুরকায়স্থ বেয়াড়াদের ডেকে জানিয়ে দেয়-‘এ রাতে খাবারে যার যতো বিল, সব বিল আমার ‘!

আমরা থ’।

২.

ভালমতো গলা খাঁকারি দিয়ে ভ্রামণিক কামরুল হাসান আলাপ শুরু করেন। তাঁকে বাধা দেয় সাধ্যি কার! বললেন, কোলাখাম থেকে কালিম্পঙের পথে আমরা যে দুটি দর্শনীয়স্থান ‘লাভা’ ও ‘রিশপ’ দর্শন করে এসেছি। দুটি দ্রষ্টব্য, আমার আছে ভিন্ন ভিন্ন  গুরুত্ব বহন করে। লাভা নিয়ে বলবো নানা হস্তশিল্পের সমাহার বৈচিত্র্যময় খাবারে পশার নিয়ে লাভা বাজার ও দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধবিহার এখানকার মুখ্য আকর্ষণ। কমপরিচিত ন্যাওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশদ্বারখ্যাত  লাভা অতীতে তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যের জনপ্রিয় রুট । হিমালয় দুহিতা ক্যাসেকেড বা পর্বতপুঞ্জের সাড়ে সাত হাজার ফুট উচ্চতার জনপদের নিকটে ছড়িয়ে থাকা বৃক্ষশোভিত প্রকৃতি, বুনোপথ ও পুস্প, আকর্ষণীয় ঝর্ণা ও খরস্রোতা ঝরা, বহুপ্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণীর সমারোহ- এর অঙ্গের অমূল্য ভূষণ।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কামরুল হাসানের লিটারারী শব্দচয়নে ‘সাধু’ ‘সাধু’ সমস্বরধ্বণি ওঠে।

বীমা কোম্পানির বড় কর্তা নাহিদ সুলতানা বললো-‘আমি ভাই কামরুল ভাইয়ের মতো সাহিত্যিক শব্দচয়নে বলতে পারবো না। আমার বলার মধ্যে ভাষার গুরুচন্ডালির জন্য কোন দোষ দেবার পারবা না কেউ। আজকের দেখা আর ভ্রমণ  নিয়ে আমার অনুভূতি সাদামাটা। কালিম্পঙ শহরের চেয়ে শহরের বাইরে চোখ জুড়ানো পর্বতরাজি আর পথে পথে সবুজ  আমার বড় ভালো লাগছে। কালিম্পঙ, লাভা, রিশপ সর্বত্রই সবুজ বৃক্ষ আর  আর উঁচু নিচু পাহাড়ের হাতছানি। আহা, রিশপ ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা যদি একবার দেখা যেতো, তাইলে ষোলকলা পূর্ণ করে দেশে ফিরতাম !

ভ্রামণিক কামরুল হাসান, নাহিদ সুলতানা দেশের পথে কাল সকালেই পাহাড়ি জনপদ থেকে নেমে যাবেন শিলিগুড়িতে। তাদের পথের নির্দেশনা দিয়ে নিয়ে যাবে বিনীতা সরকার। কালিম্পঙে পরদিনের ভ্রমণ আর আমাদের সামনের গন্তব্য দার্জিলিঙ ও গ্যাংটক ট্রিপে এই তিনজনকে পাওয়া যাচ্ছে না। কালিম্পঙয়ের দেখে আসা দ্রষ্টব্যগুলোই রইলো এই তিনের ঝুলিতে বলে তাঁদের গল্পগুলোতে ভ্রমিত স্পটেরই প্রাধান্য, আগামীর আভাস নেই। #

মাহমুদ হাফিজ
মাহমুদ হাফিজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *