আর এক মহেশ্বর

জ্যৈষ্ঠের ফ্যাকাসে আকাশের নিচে জাকারাণ্ডার ঘন নীল শামিয়ানা। গাড়ি চলেছে নীল জাজিমের ওপর দিয়ে। যেন এখনি বিউগল বেজে উঠবে। প্যারাট্রুপারের বদলে জাকারাণ্ডা ক্যানপি থেকে ঝরে পড়বে রাশি রাশি নীল ফুল। এ উৎসব সাজ কি শুধুই উচ্ছ্বাস? নাকি এই নীল রোমাঞ্চের ভেতর রয়েছে কোন গভীর রহস্য? 

চার ধামের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে উত্তরাখণ্ডে। হরিদ্বার থেকে এক গাড়িতেই উখিমঠে এসে থামলাম। রবীন্দ্রজিও কাজ সেরে এখান থেকেই উঠলেন। পূর্ব পরিচয় যেটুকু দূরাভাষেই। সদালাপী শিক্ষক। তার কাছে পেশ করলাম এ নীল রহস্যের আর্জি। 

হেসে বললেন, হিমালয়ের পথ সব সময়েই রহস্যে মোড়া। তবে এই সময়টা যেন নীলমোহরের খামে সীলমোহর করা এক অমূল্য সম্পদ। 

-নীলমোহর! সেটা কি? 

-এই যাকে জাকারাণ্ডা বলছেন। মোহরের মতই যাকে আগলে রাখতে হয়। শুধু গন্ধে বা গুণে নয়। এ ফুল ফুটলেই সবাই বোঝে এসে গেছে ডোলি-যাত্রার সময়। উখিমঠের ওঙ্কারেশ্বরের মন্দির থেকে মধ্যমহেশ্বর তার শীতকালীন গদ্দি ছেড়ে রওনা হবেন ওপরে। এ সময়ে প্রকৃতি, মানুষ যতটাই দিলদার ততটাই নাজুক। 

দেবপ্রয়াগ ছাড়াতেই একটা দুটো করে চোখে পড়ছিল জাকারাণ্ডা। গুলমোহরের মত ঝিরঝিরে পাতা। উখিমঠের আগে থেকেই তার আপ্যায়নের বাড়াবাড়ি।  

-নীলকণ্ঠর বিদায় বেলায় নীলমোহরের রং মেলান্তি, এই তো? 

-ইসে বিদাই মাত কেহেনা জি। গলা নরম করে বললেন বর্ষীয়ান মানুষটি। বরং বলুন অপেক্ষা। কেদারনাথ আগেই রওনা হয়েছেন অক্ষয় তৃতীয়ায়। মধ্যমহেশ্বরের ভোগমূর্তি উৎসব-ডোলি চড়ে এ পথেই আসবেন। মনসুনা, উনিয়ানা হয়ে নরম নীল ছায়ায়। নীলমোহরের গালচে মাড়িয়ে। পৌঁছবে রাঁসি।

গাড়ি থামল রাঁসিতেই। মোটর পথের শেষ। দূরে সবুজ পাহাড়ের সিঁথির ওপর রূপোর মুকুটের মত সাদা চুড়ো। হৈ হৈ করে ছুটে এলেন সবাই।আমাদের জন্য কতকালের প্রতীক্ষা যেন। পরিচয় হল অশোক ভাট, অনীশ ভাটের সঙ্গে। পাহাড়ি গ্রামের অনাড়ম্বর আত্মীয়তায় পাষাণেরও মন গলবে। রাশি রাশি হাসি মুখের জয়। চেঁচিয়ে উঠলেন সবাই, জয় রাঁসমাই, জয় মদমহেশ্বর। 

-মদমহেশ্বর! কেন? 

প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন এক বাঙালি!

বললেন, বন্ধু হোরাসিও, এত তাড়া কিসের? এলেন-দেখলেন-জয় করলেন বড়ই কাব্যিক। তার চেয়ে চোখ কান খুলে রেখে উপন্যাসের গড়ানে চলুন। দু’হাত উপচে উঠবে। 

আলাপ জমতে দেরি হলনা এমন এক মানুষের সঙ্গে। হরিদ্বারের মিত্রমশাই। তার চরিত্র গুণে মিত্রতাও হল। বার পঁচিশেক এ পথে তার পাড়ি। চলন্ত মদমহেশ্বর বললেও অত্যুক্তি হবেনা। 

গাড়ির রাস্তার ওপর আর আমাদের থাকার আস্তানা অশোক ভাটের ডেরায়। চা পাকোড়ার বিরতির পর গ্রাম দেখাতে নিয়ে চলল দীনেশ পাঁওয়ার। মিত্রমশাইকেও অনুরোধ করলাম সঙ্গে যেতে। তার মত এত ভাল গাইড পাব কোথায়। 

শেষ বিকেলে নন্দীকুণ্ড আর কাঁচনি পাহাড়ের সাদা মাথায় কমলার ছোপ। ধাপ-চাষ, ঘর-বাড়ি পাহাড়ের খাঁড়া দেয়াল ধরে। অন্যদিকের ঢাল ধরে হুই নিচে ফিতের মত মধ্যমহেশ্বর গঙ্গা। ডাক নাম মধুগঙ্গা। 

সিঁড়ি উঠেছে গ্রামের অন্দরে। উঠোন পেরিয়ে, ছাগল খেঁদিয়ে, গোবর ডিঙিয়ে, মেয়ে বউদের জটলা পেরিয়ে রাকেশ্বরী মন্দির। তার চাতালটা বিকেলের খেলার মাঠ। কচি-সংসদের দখলে। ফাটা গালে, রুক্ষ চুলে অভাবের লালিত্য, অযত্নের আদর। ঘণ্টা ঝোলানো ফটকের পর চাতাল টপকে গর্ভগৃহ আর মণ্ডপ নিয়ে মন্দির। তার কাঁধ থেকে উঁকি দিচ্ছে পাহাড় চুড়ো। নাইট ডিউটির অপেক্ষায় গোল চাঁদ। আরতি হতে ঢের দেরী। 

ওপরে আঙুল তাক করে দেখাল দীনেশ। গ্রামের চৌকাঠে বন। পথ বানিয়ে ডানপিটেরা যায় ফুলে ছাওয়া মান্দানি উপত্যকায়। ইয়নবুক, বিশালি, মহাপন্থ কল পেরিয়ে পঞ্চকেদারের অন্যতম কেদারনাথে। মান্দানির পক্ষ নিয়ে মিত্রমশাই একাই একশ। ফুলের বৈচিত্রে সে নাকি ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস-এর জুড়ওয়া। প্রবাসী বলে মিত্রমশাই বাংলার ঘাটতি পোষান হিন্দিতে। 

দীনেশও বেশ কয়েকবার খানিকটা গেছে মান্দানির পথে। আয়েশি ট্রেকারদের পক্ষে অসম্ভব কঠিন পথ। খানিক ভয়েই সে পথে গাইডের কাজ নিতে দেয়নি দীনেশের পরিবার। মরসুমি ঝুম-চাষ, ঘি-দুধ-উলের কারবারে চালিয়ে নেয় কোনরকম। 

পথ কি সত্যিই ভয়ংকর হয়? নাকি ভয় শুধু পথিকের মনে? 

যা কিছু সব ভেতরেই থাকে ম্যাডাম, বললেন মিত্রমশাই। পঞ্চাশ পেরনো পাহাড়িয়া মানুষটা গামছার ব্যবসায় শেষ সম্বল খুইয়েছেন। পেশা নেই। পেষাইও নেই। নেশা ভাং নেই।আছে ছবি তোলার বাতিক। আর মওকা বুঝে হাতিয়ে নেন মন্দির, মনাস্ট্রির ঘণ্টা। চুরি করা ঘণ্টা উপহার দেন ইয়ার-বন্ধুদের। সখের চোরদের ইংরেজরা ক্লেপ্টম্যানিয়াক বলে শুনেছি। ঘণ্টা-চোরের এক কথায় প্রকাশ দিতে গুগলও ভির্মি খেল। 

বললাম, চলে কি করে? বললেন, ‘বাবাকা কিরপা’। ‘বুলাওয়া এলেই চলে আসি এখানে। ভাট, পাঁওয়ার, রাওয়াত মিলে গোটা রাঁসি গ্রাম আমার বন্ধু। মনের মানুষ সব’। তার ওপর আছে চোখের ডাক্তার পূবালী। মিত্রমশাইয়ের মধ্যে বিশ্বরূপ দর্শন করে তার আর আইবুড়ো নাম খণ্ডানো হয়নি। নির্ভেজাল বন্ধুত্বে জুটেছে এই খামখেয়ালী, পাহাড় ঘুরুনের ইহজীবনের ভার। অ্যালেক্সান্ডার থাকলে বলতেন, সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এ পথ! কি বিচিত্র মানুষ!

চারদিকে উৎসবের খোশ মেজাজ। কলতলায়, পাথরের রোয়াকে, বাড়ির উঠোনে জমেছে গল্প। ঘাসের বোঝায় পিঠ নুইয়ে ফিরছে ঘসেরি বেগমরা। ফোস্কা জ্বলা পিঠে কারো জ্বালানির কাঠ। তাদের রংচটা পোশাক, রামধনু হাসি। 

আরতির ঘণ্টা বাজল। কষ্টি পাথরের মাতৃ মূর্তি। রামের পুজোয় তিনি রামেশ্বরী। রাকেশ বা চাঁদের পুজো পেয়ে তিনি রাকেশ্বরী। গ্রামের নামও তাই রাসু থেকে রাঁসি। সবার তিনি রাঁসমাই। সুখ-দুখে আপনজন। বললেন, প্রধান পুরোহিত ঈশ্বরীপ্রসাদ ভট্ট। 

এক গ্রীষ্মে গাড়োয়ালী সুন্দরীদের অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে জোছনার আলো ফেলেই বিপদে পড়েন রাকাপতি। মেয়েদের নালিশে জোটে অত্রিমুনির অভিশাপ। এইখানেই তপস্যায় কলঙ্ক ঘুচিয়ে তার শাপমুক্ত হওয়ার পৌরাণিক গল্প শুনলাম পুরোহিতের মুখে। পঞ্চপ্রদীপে, কাঁসর-ঘণ্টা-শাঁখের বাদ্যিতে আরতি হল গর্ভগৃহে। তামিল, মারাঠি, গুজরাটি, বাঙালি নিয়ে সেখানে এক টুকরো ভারতবর্ষ পুজোর প্রসাদ পেল। 

মধ্যমহেশ্বর আসছেন। তাই মন্দির সাফাইয়ে লাগলেন কয়েকজন। ট্রেকারদের কেউ কেউ ছুটলেন রান্নাঘরে মিত্রমশাইয়ের নেতৃত্বে আণ্ডাকারির ফরমায়েস করতে। মধ্যমহেশ্বর এলে কাল আর আমিষ জুটবে না। 

গুছিয়ে বসলেন ঈশ্বরীপ্রসাদ। বললেন, এই ভট্টরাই মন্দিরে নিত্য পুজো সামলাচ্ছে। উনি জনানন্দ ভট্টর ছেলে শুনে বেশ উত্তেজিত হলাম। 

হিমালয়প্রেমী স্বর্গীয় উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যমহেশ্বর যাত্রায় যার কথা জেনেছি। এ নাম শুনে ঈশ্বরীপ্রসাদ কপালে হাত ঠেকালেন। বললেন, ওনার লেখা চিঠি আর সই এখনও যত্নে আছে। আছে অনেকের সই করা একটা খাতা। তার বেশির ভাগই বাঙালির সই। তাছাড়া পথের জন্য কাঙালপনা কারই বা এমন! প্রচ্ছন্ন গর্বে হঠাৎ উদার হয়ে বললাম, আজ রাত কা খানা ম্যায় পাকাউঙ্গি। রসুই ঘরে খবর দাও।

তবে উমাপ্রসাদের দেখা রাসু গ্রামের সঙ্গে এখনকার রাঁসির মিল খুঁজতে যাওয়া বোকামি। বললাম মন্দির ঘিরেই যখন একাল সেকাল, মন্দিরেরই গল্প বরং শুনি। 

জাঁকিয়ে বসলেন পুরুতমশাই। বললেন, তখন ভোগের ব্যবস্থা হত প্রতি ঘর থেকে একদিন এক সের করে চাল নিয়ে। তারপর পঞ্চায়েত, মন্দির কমিটি সব হল। এখন রাঁসমাইকে ঘিরেই বছরে দু’বার মেলা। বৈশাখে বৈশাখী। আশ্বিনে উঁচকিনি। দ্বিতীয়টার জাঁক বেশি। ঢল নামে আশপাশের গ্রাম থেকে। শ্রাবণ-ভাদ্রে চলে পাণ্ডব-গাথার আসর। কথক শিবরাজ সিং পাঁওয়ারের বয়স হলেও বেড়ে দম। তার তালিম জগত সিং ভাট আর সাহস সিং পাঁওয়ারের কাছে। তারা নেই। চলছে পরম্পরা। শিবরাজজির শিস্যরাই এখন মঞ্চ কাঁপায়। মহাভারতের পালায় হাসায়-কাঁদায়। 

শিবরাজজি কখন এসে বসেছেন। বললেন, ছোটদের সময় নেই এসবের জন্য। তবে ঠাকুমার গল্পের ঝুলি ওই রামায়ণ-মহাভারত। তাই শুনেই বড় হয় সব। মন ছুঁয়ে রক্তে মিশে যায় মহাকাব্য। নিজেদের পাণ্ডবদের বংশধর ভাবেন অনেকেই। মুখে মুখে পাল্টায় গল্প। বেচারা পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিয়ের শিকে ছেঁড়েনি এ গল্পে। নেই মাদ্রি ম্যাডাম। রাজমাতা কুন্তি, এখানে বুড়ি দেশওয়ালি। মহাভারতের মধ্যমহেশ্বর সংস্করণ! 

মধ্যমহেশ্বরের গল্পের বীজ এই মহাভারতেই। বললেন, শিবরাজজি। কথকের বলার ধরণটিও বেশ। শ্রোতা পেয়ে উৎসাহ সপ্তমে। বললেন, ধর্মযুদ্ধে জয়ী হলেও পাণ্ডবদের স্বজন হত্যার পাপের ভার তো আর কৃষ্ণ নেবেননা। ভ্রাতৃহত্যা, গুরুহত্যা, ব্রাক্ষ্মহত্যার পাপ ঘাড়ে নিয়ে স্বর্গের পথ বন্ধ। কৃষ্ণের কথায় স্বর্গের পারমিট যোগাড় করতে তারা চললেন শিবের কাছে। 

কুরুক্ষেত্রের নিধন যজ্ঞে তাদের ওপর রেগে থাকায় শিব দেখা দিতে নারাজ। গুপ্তকাশিতে লুকোলেন ষাঁড় সেজে। তার তেজ দেখে সন্দেহ হল ভীমের। পেছন থেকে যেইনা জাপটে ধরা অমনি তিনি ছটকে ছয় হলেন। ছড়িয়ে গেলেন হিমালয়ের ছয় দুর্গম স্থানে। মন গললে জানালেন, এই ছয় জায়গায় ধ্যান-জপেই পাপস্খালন। মুঠোয় মিলবে মোক্ষ। পাণ্ডবরাও লেগে পড়লেন। মন্দিরও গড়লেন। 

কল্পেশ্বরে জটা, রুদ্রনাথে মুখ, তুঙ্গনাথে বাহু, মধ্যমহেশ্বরে নাভি আর কেদারনাথে কুঁজ। কেদারখণ্ডের পঞ্চকেদার। আর মাথা ফুঁড়ে উঠলেন নেপালের পশুপতিনাথে। 

দেহের মধ্যভাগ নাভি বলে আবার কেদার-বদ্রির মাঝে বলেও নাকি মধ্যমহেশ্বর। সবাই কপালে হাত ঠেকালেন। যস্মিন দেশে যদাচার। নাহলে শুধু আহাম্মক নয়, নাস্তিক সন্দেহে ঘটে যেতে পারে অঘটন। 

রবীন্দ্রজি আসায় গাড়োয়ালী হিন্দির হিন্দি অনুবাদে কিছুটা সুবিধে হল।  তিনি সবার প্রিয় মাস্টারজি। গল্পের মোড় ঘুরল পেছনে। তখন মধ্যমহেশ্বরের হাঁটা শুরু হত উখিমঠ থেকেই। জঙ্গলে ওত পেতে থাকত বিপদ। কত তীর্থযাত্রীদের আর খবর মিলতনা। পথে অসুস্থ হলে মরেই বাঁচতে হত। মধুগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে সৎকার একরকম স্বর্গের দরজায় কড়া নাড়া। 

কুণ্ডে এ নদী মিশেছে স্বর্গের আর এক নদী কেদারনাথ থেকে আসা মন্দাকিনীতে। স্বয়ং উমাপ্রসাদ যাত্রা শুরু করেছিলেন উখিমঠ থেকেই। তার যাত্রাপথের সেই ভয়ংকর সুন্দর জঙ্গল আর নেই।  

পথও কমেছে, বললেন ঈশ্বরীপ্রসাদজি। উখিমঠের পর আগে মনসুনা, পরে উনিয়ানা থেকে শুরু হত হাঁটা। মোটরপথ এখন রাঁসির পরের গ্রাম গৌণ্ডারের কাছে। এই নিয়ে দুই গ্রামের সম্পর্ক ঘোলাটে। স্বচ্ছন্দে ছয় কিলোমিটার এগিয়ে যেতে কে না চায়। রাঁসির গুরুত্ব কিছুটা তো কমবে। এখন মানুষের তাড়া বেশি। হতাশ সুরে বললেন শিবরাজজি।  

এ পথে রাঁসির টান বাঁশীর সুরের মত। মানুষ আসবেই। বললেন, রবীন্দ্রজি। সত্যি। এত সরল সুন্দর গ্রামে আবার ফিরতে ইচ্ছে করে। ‘পিছুটান এক মায়া রোগ’। হঠাৎ এসে বললেন মিত্রমশাই। সীমানা পেরোলেই গলা বুজে আসে। ঝাপসা হয় চোখ। মদমহেশ্বরজি, ওঙ্কারেশ্বর ছাড়লে এমনই হয় সবার। 

তার ফেরার প্রস্তুতি আগের দিন থেকে, বললেন রবীন্দ্রজি। গর্ভগৃহ ছেড়ে সকালেই মণ্ডপে দর্শন দেন মদমহেশ্বরজি। বৈশাখের নতুন আনাজে ভোগ দিয়ে তবেই সে ফসল ঘরে তোলে গৃহস্থ। মহাভিষেক সেরে শৃঙ্গার করে দেন প্রধান পুরোহিত। কর্ণাটকের মহীশুরের লিঙ্গায়েত ব্রাক্ষ্মণ ছাড়া এ অধিকার নেই কারো। আর্যাবর্তের ভগবানের পুজোর ভার দাক্ষিণাত্যের ব্রাক্ষ্মণের। মিলে যায় আর্য-অনার্য। 

নতুন গমের আটার পুরি, মিষ্টি পাকোড়ার শুখা ভোগ মন্দিরেই বানায় ভক্তরা। আজ সারাদিন এইসবই চলেছে সেখানে। কাল সকালেই ডোলি-যাত্রা। ডোলির সঙ্গেই মন্দির পরিক্রমা করেন ভক্তরা। যাত্রার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সবাই। যেন বাড়ি ছেড়ে বাবা চলে যাচ্ছেন। পাকদণ্ডি পথ বেয়ে উঠে আসে ডোলি। পাথুরে পথে দণ্ডি কেটে চলে কেউ। বেশির ভাগই ফিরে যায় উনিয়ানা থেকে। বলে যায়, সাবধানে যেয়ো। আবার এসো। 

আসা-যাওয়ার মাঝে সেতু গড়ে অপেক্ষা। ফিরে আসার টানও হয়তো সেটাই। যে অপেক্ষার প্রান্ত ছুঁয়ে থাকে বিজয়া-আগমনী, ভাটিয়ালি-সারি। তারই দুপ্রান্তে ওঙ্কারেশ্বর-মধ্যমহেশ্বর। 

রান্নার জন্য তাগাদা দিলেন মিত্রমশাই। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে স্বেচ্ছায় নিতে চাওয়া বাঁশের গুঁতোয় চললাম অশোক ভাটের রান্নাঘরে। বাঙালি রাঁধবে শুনে সব বাঙালির এক রা। সবাই আজ এখানে খাবেন। অশোক আর তার স্ত্রীও হাত লাগালেন। তীর্থপথে ডিম রেঁধে আমার কি পুণ্যি হল, না পাপ? জানা নেই। টবে সবাই একসঙ্গে আনন্দ করে খেলেন, এটুকুই প্রাপ্তি। 

বাইরে এসে দেখি চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে রাঁসি। নন্দীকুণ্ডের চুড়োয় যেন গলা মোম। শব্দ বলতে শুধু মধুগঙ্গার বয়ে যাওয়া। 

সকাল এখানে সাত সকালেই কেজো নেশায় ব্যস্ত। শালিক, চড়াই আর মরচে বাদামি রঙের পাখি ছোট পেঙ্গা (Streaked Laughing thrush) দোকানের চাতালে মুড়ি খাচ্ছে। দলে পাখি চেনানোর ট্রেকার থাকায় সুবিধে হল। জয় রাঁসমাই, জয় মদমহেশ্বর, বলে হাঁটা শুরু হল। সঙ্গী তল্পিবাহক অনীশ। 

মধুগঙ্গার উজানে পথ উৎরাই। বেশ খানিকটা পিচরাস্তা। মোটরপথের কাজ চলছে। শিকারের খোঁজে চক্কর দিচ্ছে শিকারি পাখি। গর্ত থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখছে গুঁফো ইঁদুর। বাঁক বদলের সময় ফিরে দেখলাম। রঙিন বাড়ি, ধাপ চাষ, মন্দিরের চুড়ো, আকাশ ছোঁয়া গাছ নিয়ে আলো মাখা রাঁসি। ‘পথিককে শেকড় গাড়তে নেই’, বলে হাসলেন মিত্রমশাই। এতটুকু সঙ্গে এলেন। আজ রাঁসিতেই থাকবেন। ডোলির সঙ্গে আসবেন। এগিয়ে চললাম গৌণ্ডারের দিকে।  

রোদকে টেক্কা দিতে এগিয়ে এল বন। গাছের ছায়ায়, নদীর হাওয়ায় কষ্টের কেষ্ট প্রাপ্তি। নিডল পাইনের তলা বিছিয়ে পাইনকোন। গুঁড়িগুলোর গায়ের ফাটল যেন জ্যামিতিক ফ্রেস্কো। সবুজ ফালা করে নামছে ঝর্ণা। তার দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় কে যেন রিপ্লে বোতাম টিপে হারিয়ে ফেলেছে রিমোট। মধুগঙ্গাকে দেখা না গেলেও শোনা যাচ্ছে। পাওডার পাফের মত গোলাপি সুড়সুড়ি ফুলে প্রজাপতিদের দুর্বার মধু লুঠ। সিংহের দাঁতের মত ধারাল রোঁয়া পাপড়িওলা ড্যাণ্ডেলিয়ানদের পাশ কাটিয়ে মধুখোর 

ভোমরাগুলো গিয়ে বসছে বুনো গোলাপ, তুলতুলে ঘাসফুলের ওপর। দুনিয়া শক্তের ভক্ত। 

হঠাৎ কাঁটাঝোপের ভেতর কি যেন সড়সড় করে উঠল। রঙ্গিলা গিরগিটি! সুলেখা নীলের বোতলে শরীরের অর্ধেকটা ছুপিয়েছে সে। ক্ষতি করেনা অথচ পোকা মাকড় খায় বলে শুনেছি আফ্রিকাতে এই ‘রক আগামা’ বাড়িতে পোষার চল আছে। পথের ধারে নানা বুনো ফুল। জংলি স্ট্রবেরি খেতে বেশ টক মিষ্টি। বনের অন্দরমহলে প্রকৃতির নাট্যমঞ্চ কাঁপায় এইসব রথী মহারথীরা! 

মধুগঙ্গার দেখা পেলাম গৌণ্ডারে। তার পাড়েই মন্দির। ডোলি-যাত্রায় এখানেই রাত কাটাবেন মদমহেশ্বর। আমাদের বিরতি। কয়েকটা সিঁড়ি উঠে রমেশজির বাড়ির দাওয়ায় জিরিয়ে নিলাম। পাখি দিদিমণি দেখালেন তারে বসে থাকা সাদা কালো ছোট পাখিটা গ্রে বুশ চ্যাট। গরম গরম রুটি তরকারি খেয়ে আবার হাঁটা শুরু। আকাশ ময়লা। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। শুরু হল চড়াই। 

১৯৩৪। বদ্রিনাথ থেকে তুষারপথে কেদারনাথ আসার ইচ্ছে নিয়ে শতপন্থ হিমবাহ পেরিয়ে এই উপত্যকায় নামেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী এরিক শিপ্টন ও বিল টিলম্যান। এত সবুজে তারা সন্মহিত। পথের খ্যাতিও তাই গ্রিনট্রেক বলে। এক বিদেশিনী নামছিলেন। বললেন, আমাদের আল্পস আছে বটে,  তবে হিমালয় অতুলনীয়। 

খানিক এগিয়ে নদীসঙ্গমের ওপর সেতু। অনীশ বলল, চৌখাম্বা থেকে মার্কণ্ডেয় গঙ্গা মিশেছে নন্দীকুণ্ড থেকে আসা মধ্যমহেশ্বর গঙ্গায়। বয়ে গেছে  মধুগঙ্গা নাম নিয়ে। এক সন্তানহীন রাজার পুত্র লাভের গল্পে এ সঙ্গম এক মহাতীর্থ। 

কয়েক ঘর নিয়ে ছোটি বানতলি। এখানেই দ্বিতীয়বার তুলা সিং এর সঙ্গে দেখা হয় উমাপ্রসাদের। তুলা সিং তখন সাধন পথের ঠিকানা পাওয়া এক অন্য মানুষ। বনতল বলে নাম রাখেন বানতলি। 

তাক লাগা চড়াই চড়ে যেখানে দমছুট তারই নাম ‘বাংগাল কা লড়াই’। এ পথে ‘শের বাঙালি’র সেরা বাঙালি উমাপ্রসাদের সন্মানেই এ নাম। আর এক পাও চলতে পারছিনা। কিন্তু থামলে তো আর চলবে না। 

বিকেলের আগেই কোনমতে পৌঁছলাম আপার বানতলি। বলবীর পাঁওয়ারের ন্যাড়া ছাদে এসে দাঁড়ালাম। 

জুতো খুলতেও কষ্ট হচ্ছে। বুড়ো আঙুলের নখে চাপ পড়ে রক্ত জমাট। তেমনই ব্যথা। তড়িঘড়ি ঠাণ্ডা-গরম জলে পায়ের শুশ্রূষা করলেন বলবীরের স্ত্রী। তাকে কি আপনজন বলতে পারি? 

রান্না সেরে, সবাইকে খাইয়ে তিনি আলুর বস্তা পিঠে করে নিয়ে এলেন রাঁসি থেকে। তাও সন্ধের আগেই। যে পথটুকু আসতে আমাদের প্রাণান্তকর হাল। 

রূপোলী ওকের পাতায় তখনও ঝিকমিক করছে দিনের শেষ আলো। একটাই ডালে বারবার এসে বসছে পাকা পাতিলেবু রঙের হলুদ পাখি, ফুটফুটি। 

সন্ধে হতেই যেন জঙ্গলটা ছাদে এসে দাঁড়াল। কেদারনাথ অভয়ারণ্যের বাফার জোন হলেও এটা আসলে বন্যদেরই ডেরা। দখল নিয়েছি আমরা। 

যে কোন সময় স্বর্গীয় সুগন্ধ ছড়িয়ে এসে দাঁড়াতে পারে একটা কস্তুরি হরিণ। তার পিছু নিয়ে মৃত্যুর মত ঘাতক চিতাবাঘ। জানলা খুলে তার হাই তোলা দেখাটা স্বপ্নই থেকে গেল। বদলে ঢুকে পড়ল এক খাবলা অন্ধকার। যা সইয়ে নিলে চেনা যায় মুখ। সে মুখ কি বলবীরের বউয়ের? স্নেহের মত সরল। অতিথিকে না খাইয়ে খায়না যে। সে তো ছিলনা তখন। তবে কার টানে এখানেই একটা আস্ত ভিটে গড়েছিলেন উমাপ্রসাদ? বৃষ্টি নামল। 

আলো ছুঁল সবচেয়ে উঁচু গাছটার মাথা। ঝকঝকে আকাশ। অনীশের পিছু নিয়ে চললাম। এইবার নাক লাগা চড়াই। খাটারা খালের আগেই ফের দেখা হল নীলমোহরের সঙ্গে। অনীশ বলল, অনেক সবুরে এ গাছে ফুল আসে। এক বাঁকে মাউন্ট মান্দানি ভ্যানিশ হলে অন্য শৃঙ্গরা কাছে এল। 

ক্লান্ত পা টেনে, ফুসফুসে দম দিয়ে, নানুচট্টিতে চা খেয়ে, মইখাম্বা পার হলাম। অনীশ বলল, মইখাম্বার খাঁটি ঘিয়ের নামডাক আছে। দেখলাম এক পাল ধেড়ে হনুমান এদিক সেদিক ঘুরছে। 

শেষ চট্টি কুন। ছোট্ট এক চিলতে ঘরের নাম প্রিন্স হোটেল। উচ্চতার কারণে দু’মিনিটের কিছু বেশিই সময় লাগল ম্যাগি বানাতে। বেঞ্চে বসে কল্কেতে টান দিচ্ছেন এক শুভ্রকেশী জটাধারী। অনীশ বলল, উনি মহেশ্বরজি। সংসার ছেড়েছেন সাধনের টানে। সাধক! দেখে মনে হলনা। অবশ্য খোলসেই কি বোঝা যায় কোন ঝিনুকে মুক্ত আছে? 

ওনার পাশেই বসলাম। ঘোড়া থেকে কোলে চড়ে নামলেন এক গোলগাল লোক। অসাড় কোমর হাল্কা দোল খাইয়ে সাড় ফেরাচ্ছেন। ডাণ্ডি চড়ে উঠে আসছে এক সুন্দরী তরুণী। চওড়া লিপস্টিকের ভেতর এক ছিলিম হাসি। 

চার ডাণ্ডি বাহকের প্রাণান্তকর দশা। তাদের পায়ের আওয়াজে একটা বড় পাখি ধুসর ডানা মেলে উড়ে গেল ঝোপের ভেতর থেকে। অনীশ বলল, মোনাল থি। মানে, মেয়ে মোনাল! রংবাজ পুরুষ পাখিটাকে দেখিয়েছিলেন তুঙ্গনাথের রাওয়াতজি। 

হৈচৈ শুনে দেখি ঘোড়াওলার সঙ্গে মিস্টার গোলগালের ধুন্ধুমার। পিঠের ওপর বসার আসন ফেলে ঘোড়া পালিয়েছে। ঘোড়াওলা খানিকটা গিয়ে তাকে পায়নি। হেঁটে উঠতে বলায় যত বিপত্তি। জটাধারী বললেন, ঘোড়া সোজা মদমহেশ্বরে গিয়ে থামবে। তার প্রতিদিনের গন্তব্য। এদিকে ঘোড়াওলার রুজিতে টান। অনলাইনে বুকিং বলে আগাম টাকা নেওয়া। ঘোড়াগুলোর কান ফুটো করে তাই চিপ লাগানো। মানবিকতা ছাড়া মানুষের আর সব গুণই আছে।

রডোডেনড্রনের স্যাঁতস্যাঁতে জঙ্গলে পায়ের নিচে পাতার পাহাড়। সব দৃশ্য অদৃশ্য করে একঘেয়ে সবুজ অন্ধকার। রডোডেনড্রন ফুল ফোটার মরসুম শেষ। মাঝে মাঝে দু’একটা লাল ফুল। এখানে বলে বুরাঁস। ফুল দিয়েই তৈরি হয় ফুসফুসের জন্য উপকারী স্কোয়াশ। সে কারণেই প্রতি বছরই শহীদ হয় বীর বুরাঁসের দল। উখিমঠে স্কোয়াশের একটা বড় দোকান দেখেছেন, বললেন সহযাত্রী কর্নেল সাব। 

ফুসফুস জোড়াকে আওর থোরা, দম লাগাকে বলতে বলতে চড়ি শেষ চড়াইটুকু। অনীশের চলা অবশ্য ঢের কঠিন। উনিশ বছরের ছেলেটা কলেজে যায়না। কলজের জোরে পিঠে মাল নিয়ে প্রতিদিন পাহাড় চড়ে। যাত্রী ওর ভগবান। মদমহেশ্বরের দয়ায় চলে যায়। ছেলেবেলা থেকে সখ,একটা ভায়োলিন কিনবে। কি সুর বাজাবে সে? মিটিমিটি হাসে ছেলেটা। চোখে ঝিলিক দেয় এক ফালি স্বপ্ন। 

হঠাৎ এক সমতলে এসে পড়ি। কয়েক হাত তফাতেই মদমহেশ্বর মন্দির। যাকে দেখেই মনে হল বিশাল গিরিশৃঙ্গের পায়ের কাছে করজোড়ে রাজর্ষি ব্রক্ষ্মকমল। সমুদ্রতল থেকে ১১,৪৭৩ ফুট ওপরে। চৌকো বাঁধানো জমির ওপর। বন্ধ দরজা। কেদারক্ষেত্রের অন্য মন্দিরের মতই গঠন। চুড়োয় কলস। একদিকে গাভীমুখ থেকে জলের ধারা। অন্যদিকে পার্বতী ও শিব-পার্বতী মন্দির। পেছনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একই প্রজাতির ছ’টি চিরহরিত গাছ। এরা নাকি সস্ত্রীক পঞ্চপাণ্ডব! বললেন, এক নম্বর হোমস্টের মালিক, ভরতজি। তার কাছেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। 

রূপোলী পাখির মত উড়ে আসছে টহলদার হেলিকপ্টার। নামল এসে অস্থায়ী হেলিপ্যাডে। প্রচুর পুলিশ পাঠিয়েছে উত্তরাখণ্ড সরকার। শোনা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই খুব ধনী দেবতা মদমহেশ্বর। কাল তিনি ফিরছেন। তাই এত সাজো সাজো পাহারা। নেতা, মন্ত্রীরাও আসবেন, বললেন ভরতজি। মনে মনে বলি, অসীম ধন তো আছে তোমার। অনীশকে একটা ভায়োলিন দিয়ো। ও যে সুরে থাকতে চায়। 

চোখে মুখে জল দিয়ে, জল খেলাম ওই গাভীমুখ থেকে। এখানকার এক বিন্দু জলেও নাকি মোক্ষলাভের গুণ। পাণ্ডবদের কষ্টার্জিত মোক্ষ এখন সহজেই হাতের মুঠোয়। তবে তীর্থযাত্রা পূর্ণ করতে আরও কিলোমিটার দুই উঠতে হবে বৃদ্ধ মদমহেশ্বর। 

সে পথে ঘাসের সবুজ গালচের ওপর রঙিন ঘাসফুলের নকশা। পেছনে ক্রমেই ছোট হয়ে আসে মদমহেশ্বর উপত্যকা। ওপরে সবুজ এক ঢেউ খেলানো মাঠ। যার চারদিকে তুষার রাজ্য। গোটা চারেক ডোবা। বৃষ্টি হয়নি বলে জল নেই। মাঝখানে বুড়া বাবার পাথুরে আস্তানায় একটা বেল আর দশ টাকা রাখা। সেসব ছুঁয়েও দেখেননি বৃদ্ধ ভগবান। স্থায়ী বিগ্রহ। বয়সের ভারে চলতে অক্ষম। তাই মদমহেশ্বর নেমে গেলেও বরফরাজ্যে একা তিনি। সব দেখেশুনে রাখেন অভিমানী মুখে। অবশ্য তার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কেদারনাথ, সুমেরু, মান্দানি, চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ, কামেট, ত্রিশূলের মত সেলেব্রিটি হিমালের দল। এখানে দাঁড়ালে ধুয়ে যায় সব সঙ্কোচ, মুছে যায় সব গ্লানি।   

গোধূলির লাল আলোয় অনন্য দৃশ্য। নীল বুরাঁসের বনে কিসের যেন শব্দ। সন্ধের আগেই নেমে আসতে হবে বলে ফেরার পথ ধরলাম। নির্ভীকদের পথ গেছে অনেক দূর। 

মদমহেশ্বর মন্দিরের পেছনের পথ ধরে কাঁচনি খাল, পাণ্ডুসেরা, নন্দীকুণ্ড, মনপাই বুগিয়াল, বংশীনারায়ণ হয়ে হেলং। কাঁচনি খাল থেকে কাঁচনি তাল পেরিয়ে সুরাজ সরোবর হয়ে পানপাতিয়া কল। ভৈরবনাথের পুজো করতে তুলা সিং রোজ আসতেন এই কাঁচনি খালের পথে।

এদিকেই সেই পুরাণ পথ। তিব্বত থেকে যে পথে এসে এক গাভী রোজ দুধ ঢেলে যেত মদমহেশ্বরের শিবলিঙ্গে। অথচ অন্য সময় দুধ দিত না বলে একদিন মালিক তার পিছু নিল। কীর্তি দেখে অগ্নিশর্মা হয়ে যেই না লাঠির আঘাত করেছে অমনি সে সরে গেছে। আর শিবলিঙ্গ ফেটে গেছে মাঝ বরাবর। সেই থেকে গৌণ্ডারের সব গরু ছেড়ে দেওয়া হত ডোলি-যাত্রার সময়, বলছিলেন রমেশজি। একমাত্র দুধালো গাভীগুলোই যেত শেষ পর্যন্ত! বলল, অনীশ। তার মুখে এ গল্প খানিক বদলেও গেল।   

মন্দির চত্বরে জ্বলছে সৌর আলো। পুলিশের সতর্কবার্তা, কাল সূর্যোদয়ের আগে নেমে যেতে হবে সবাইকে। পেছন ফিরে তাকানো যাবেনা আর। ভরতজি বললেন, একবার শীতে মন্দিরে চুরি হওয়ায় কড়াকড়ি বেড়ে গেছে। মন্দির কমিটির দুজন থাকবেন। মদমহেশ্বরের ব্যবহারের সব জিনিস তারা বার করে রাখবেন চাতালে। ডোলি এসে থামবে কিছুটা দূরে। বেজে উঠবে শাঁখ। উঠে আসবেন ভগবান। ফুলে সাজানো মন্দিরের কপাট খুলবে।

সে সময়ে থাকতে পারবনা। সময়ের শাসন। দর্শন জুটল না বিগ্রহের। দেখা হলনা সন্ধারতি। জ্বালা হল না দীপ। তবু এই প্রকৃতি তার অস্তিত্বের আশ্বাসে  শান্তি দিল। 

সূর্যোদয়ের আগেই নামতে শুরু করলাম। পথেই উর্দিধারীদের অস্থায়ী সংসার। উঠে আসছেন গ্রামের মানুষ। সাধু সন্ন্যাসীরা। কাঁসর বাজছে। আগে পিছে ভক্তের দল। একজনের হাতে প্রণামীর থালা। সাদা ধুতিতে দুই পতাকা বাহক। বাকিরা গেরুয়ায়। শক্ত কাঁধে ধ্বজা আর ত্রিশূল বইছে দুজন। দুজন তল্পিবাহক। দুই পুরুতের কাঁধে চেপে উঠছে ডোলি। রূপোর ডোলির মাথায় রূপোর ছাতা। লাল হলুদ কাপড়ে ঢাকা বিগ্রহ। পেছনে জব্বর সাজে ঘোড়ায় চড়ে প্রধান পুরোহিত। আর সিনেমার মতই সব শেষে পুলিশ। শেষের দুজন ছাড়া সবার খালি পা! ভক্তির শক্তি।  

মইখাম্বার বাঁধানো বেঞ্চে নামল ডোলি। ঘোড়া থেকে কোলে চড়ে নামলেন প্রধান পুরুত। তফাতে বসে গাঁজায় টান দিচ্ছিলেন কুনচট্টির সেই মহেশ্বরজি। ইশারায় ডাকলেন। উৎসবের মওকায় পাব্বনি উসুলের মতলব নাকি? 

হঠাৎ ‘জুতা জুতা’ চিৎকারে ঘাবড়ে গেলাম। ভক্তিভাবে জ্ঞানশূন্য হয়ে এক পরম ভক্ত জুতো পরেই ছুঁয়ে ফেলেছেন ডোলি। সঙ্গে সঙ্গে সব অশুদ্ধ। এমনকি স্বয়ং মদমহেশ্বরও। মন্ত্রপাঠ শুরু হল। আর অমনি চারদিকে আবার শুদ্ধ ভাব। পাপের বোঝা নামায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বেচারা ভক্ত। 

বেশ জোরে হেসে উঠলেন মহেশ্বরজি। বললেন, আন্দার শুধ, তো বাহার শুধ। ভিড়ের ভেতর এক নব দম্পতিকে দেখিয়ে বললেন, তখন মহাদেব সবে বিয়ে করেছেন। মধুচন্দ্রিমা করতে এলেন এই উপত্যকায়। চৌখাম্বার পায়ের কাছে। নির্জন পর্বতে পার্বতী প্রেমে মাতাল হলেন। সবাই বলল, মত্ত মহেশ্বর। সেই থেকে মদমহেশ্বর। 

মিত্রমশাই কখন এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, উত্তর পেলেন তাহলে। আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, এর সঙ্গে কিছু জুড়ে অনীশকে দেবেন। ওর একটা ভায়োলিন কেনার সখ।   

ডোলি চলল। এত টাল খাচ্ছে যেন পড়ে যাবে। মুহুর্মুহু প্রণাম করছে সবাই। মহেশ্বরজি বললেন, বাবা, খুশি মে পিয়ে হুয়ে। গাঁজায় লম্বা টান দিয়ে বললেন, ভেতরে তাকিয়ে দেখ, এ ভ্রমণে তুমিও খুশিতে মাতাল। বাইরের মত্ততা কমলে ভেতরের রহস্যে মন দিও। সেখানে শুধুই আনন্দম হি আনন্দম। এই সদানন্দই মহেশ্বর। তাকে পেতে হলে জাতের মাতাল হতে হয়। তখন ভেতর-বাইরে, তুমি-আমি সবই মহেশ্বর। 

ওপরে দুলে উঠল নীলমোহর। 

শর্ব্বা ঘোষ নাথ
শর্ব্বা ঘোষ নাথ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *